শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান – একজন মহানায়কের সংক্ষিপ্ত জীবনী

জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর ৮৫ তম জন্মবার্ষিকী আজ। এই বাংলার মাটিতে যুগে যুগে যতোজন ক্ষনজন্মা মহাপুরুষে জন্ম হয়েছে শহীদ জিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিপ্লবী ও ক্যারেশমাটিক নেতাদের একজন।

জিয়াউর রহমানের জন্ম ১৯ জানুয়ারী ১৯৩৬ সালে বগুড়ার বাগবাড়ীতে। তার বাবা মনসুর রহমান একজন রসায়নবিদ হিসেবে কলকাতাতে সরকারী চাকুরী করতেন। তার শৈশবের কিছুকাল বগুড়ার গ্রামে ও কিছুকাল কলকাতাতে কেটেছে। দেশবিভাগের পর (১৯৪৭) তার বাবা করাচি চলে যান। তখন জিয়া কলকাতার হেয়ার স্কুল ত্যাগ করেন এবং করাচি একাডেমী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঐ স্কুল থেকে তার মাধ্যমিক পরীক্ষা দেন এবং তারপর করাচিতে ডি.জে. কলেজে ভর্তি হন।

১৯৫৩ সালে তিনি কেকুলে পাকিস্তান মিলিটারী একাডেমীতে শিক্ষানবিস অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৫ সালে তিনি সেকেন্ড লেফটেনেন্ট হিসেবে কমিশন প্রাপ্ত হন। তিনি সেখানে দুই বছর চাকুরি করেণ, তারপর ১৯৫৭ সালে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করেন। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি খেমকারান সেক্টরে একটি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন এবং তার কোম্পানি যুদ্ধে বীরত্বের জন্য যে সব কোম্পানি সর্বাধিক পুরষ্কার পায়, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমীতে একজন প্রশিক্ষক হিসেবে দ্বায়িত্ব পান। সে বছরই তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা স্টাফ কলেজে কমান্ড কোর্সে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি জয়দেবপুরস্থ সেকেন্ড ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিয়োগ পান। উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য তিনি পশ্চিম জার্মানীতে যান। ১৯৭০ সালে একজন মেজর হিসেবে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামে অষ্টম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে নিয়োগ পান।

২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যখন এদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বরের মতো ঘৃণ্য হামলা চালায় তখন এর আকস্মিকতায় দিশেহারা হয়ে পড়ে সবোর্স্তরের জনগণ।

১৯৭১-এর ২৬ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর আক্রমণের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করে ২৭ মার্চ চট্টগ্রামস্থ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তিন সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হন। তিনি সেনা সদস্যদের সংগঠিত করে পরবর্তীতে তিনটি সেক্টরের সমন্বয়ে জেড ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে যুদ্ধপরিচালনা করেন। স্বাধীনতার পর প্রথমে তিনি কুমিল্লা ব্রিগেড কমান্ডার এবং ১৯৭২ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ-অফ-স্টাফ নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সালে কর্নেল, ১৯৭৩-এর মাঝামাঝি ব্রিগেডিয়ার এবং শেষ দিকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

বৃহত্তর চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা জেলার কিয়দংশে মুক্তিপাগল মানুষকে মেজর জিয়া সংগঠিত করেন এবং পরবর্তীতে ‘জেড ফোর্সের’ অধিনায়ক হিসেবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নেতৃত্ব দেন সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। দীর্ঘ নয় মাস মরণপণ লড়াই করে অজির্ত হল সবুজ জমিনে ওপর রক্তলাল সূর্যখচিত পতাকাসমৃদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশ- আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। লাখো শহীদের পবিত্র রক্ত আর হাজার হাজার মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অজির্ত হল এদেশের স্বাধীনতা। গণতন্ত্র এখানে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, শোষন বঞ্চনার অবসান ঘটবে, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জিত হবে এবং আত্মনির্ভরশীল ও মর্যাদাসম্পন্ন জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াব- এই ছিল সেদিনের স্বপ্ন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। স্বাধীনতা যুদ্ধে জিয়াউর রহমান যুদ্ধের পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। ১৯৭১ এর জুন পর্যন্ত ১ নং সেক্টর কমান্ডার ও তারপর জেড-ফোর্সের প্রধান হিসেবে তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বে জন্য তাকে বীর উত্তম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের প্রথম আবির্ভাব হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চে, যেদিন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিশেহারা বিভ্রান্ত মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছিলেন । দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি অনেকটা পেছনের কাতারে স্ব-পেষায় ফিরে যান । দ্বিতীয়বারের মত তাকে আবার রাজনীতিতে দেখা গেল ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর । এবারেও রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব ধুমকেতুর মত হঠাৎ করেই হয়েছিল । কিন্তু এবার আর তিনি ধুমকেতুর মত বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের অন্ধকারে হারিয়ে যাননি । বরং মানুষের মনের মনিকোঠায় তিনি চিরস্থায়ী হয়ে রয়েছেন ।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ঘটনার একটি পটভূমি দেয়া দরকার । স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের পর আওয়ামীলীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় । আওয়ামীলীগের ৩ বছরের শাসনামালে জনজীবন বিভিন্নভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে । আইন শৃঙ্খলার চরম অবনতি, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির আকাশ ছোঁয়া মূল্য, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের কবলে ব্যক্তি জীবনের নিরাপত্তাহীনতা-সব কিছুই জনগণের জন্য ছিল অনেকটা জগদ্দল পাথরের মত । জনগণের মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা-এর সব কিছুই কেড়ে নেয়া হয়েছিল । তৎকালীন শাসক সরকারী ৪টি পত্রিকাবাদে সকল পত্র-পত্রিকা বন্ধ ঘোষণা করে এবং সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একদলীয় বাকশাল শাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় । অন্যদিকে ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধে প্রভূত সাহায্য করায় তৎকালীন শাসক এদেশের শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য ভারতের ইচ্ছাক্রমে রক্ষী বাহিনীকে প্রচুর কর্তৃত্ব দান করে । যে সুযোগে ভারতীয় বাহিনী দীর্ঘকাল এদেশের অভ্যন্তরে অবস্থান করে নানাবিদ যন্ত্রপাতি ও সমরাস্ত্র ভারতে চালান দেয় ।

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের অভ্যূত্থাণ সংগঠিত হয় এবং এতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্ব-পরিবারে নিহত হয় । অভ্যূত্থানটি ছিল মর্মন্তুদ ও শোকাবহ । তবে দেখা গেল যে, ক্যু’দেতার পরে আওয়ামীলীগের একজন সাবেক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ক্ষমতায় আসীন হন । অভ্যূত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী নেতা ও কর্ণেল রশিদ প্রেসিডেন্ট পদে বসালেন খন্দকার মোশতাক আহমেদকে । এদের সকলের পরামর্শমত খন্দকার মোশতাক জেনারেল জিয়াকে করলেন চিফ অব স্টাফ, তবে পদটির ক্ষমতা ও মর্যাদা অনেক কমিয়েছিলেন । সবার উপরে ডিফেন্স উপদেষ্টা হিসেবে বসানো হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সর্বাধিকানায়ক, বঙ্গবন্ধুর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম. এ. জি ওসমানীকে ।
মাত্র আড়াই মাসের শাসনের মাথায় বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলের পাল্টা ক্যু’র প্রচেষ্টা শুরু হয় । তারা ২রা নভেম্বর রাতে জিয়াকে গৃহবন্দি করলেন এবং একই তারিখে মোশতাক সরকারের পতন ঘটালেন । ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলের বিপ্লবের শুরুতে ২রা নভেম্বর রাত্রিতে জিয়াকে বন্দি করা হলেও, জিয়া যেমন ছিল নিরপেক্ষ ও ন্যায়নিষ্ঠ তেমনি নিঃস্বার্থ ও নিরহংকার । বিগ্রেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ও শাফায়াত জামিলদের ক্যু’র বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ সিপাইরাও বিদ্রোহ করল এবং তারা সফলও হল । জিয়াউর রহমানের গুণে মুগ্ধ বিদ্রোহী সিপাহীরা জিয়াকে ৭ নভেম্বর বন্দীদশা থেকে অযাচিতভাবে ‍মুক্ত করে এবং অযাচিতভাবেই তাকে করা হয় সেনা বাহিনীর প্রধান।  ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে মাত্র চারদিনের বন্দিদশা কাটিয়ে তিনি যে শুধু মুক্ত হয়েছেন তা নয় বরং ছাত্র-জনতা-সৈনিকের কাছে তিনি আবিভূর্ত হয়েছেন গণতন্ত্রের ত্রানকর্তা রুপে, দেশবাসীর আশা-আকাঙ্খার প্রতীকরুপে অনেকটা শেষ ভরসার মতই । ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতাশীন হন কোন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নয় । কোন পূর্ব পরিকল্পনার মাধ্যমেও তিনি ক্ষমতায় আসেননি । তিনি ক্ষমতাশীন হলেন বিপ্লবের সদর দরজা দিয়ে । তাকে ক্ষমতাশীন হতে হয়েছিল জাতীয় স্বার্থে, জাতীয় ঐক্য সমুন্নত রাখার লক্ষ্যে । ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের মাধ্যমের জেনারেল জিয়াউর রহমান জাতীয় স্বার্থে জাতীয় জাহাজের কাণ্ডারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

তাঁর প্রতি জনগণের আস্থা আছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য হ্যাঁ-না ভোট নেন। দেশের ৮৮.৫০ শতাংশ ভোটার ভোট দেয় এবং তাদের মধ্যে ৯৮.৯ শতাংশ হ্যাঁ ভোট দেয়।

এরপর ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলে রাজনৈতিক দল গঠন করেন। বিএনপি গঠন করার আগে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠন করা হয়েছিল। পরে তা বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে প্রধান করে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, বিএনপি। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর রমনা রেস্তোরাঁয় আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করে দলের যাত্রা করেন জিয়াউর রহমান।জিয়াউর রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থাতেই ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিএনপি ২৯৮টি আসনের মধ্যে ২০৭টিতে জয়লাভ করে। তখন মালেক উকিলের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ৩৯টি ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ২টি আসনে জয়ী হয়।

নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার মাত্র দুই বছরের মাথায় ক্ষমতা গ্রহণের দুই বছরের মাথায় ১৯৮১ সালের ২৯ মে চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন ক্ষনজন্মা এই মহান নেতা।

জিয়া লাইব্রেরী অনলাইন
Logo