বাংলাদেশ ও জিয়া একে অপরের সম্পূরক: ড. জাহিদ দেওয়ান শামীম

জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : স্বাধীন বাংলাদেশ ও জিয়াউর রহমান একে অপরের সম্পূরক । মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার অপর নাম জিয়াউর রহমান। জিয়াকে বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। জিয়া বাংলাদেশের আপামর জনগণের হৃদয়ে মেজর জিয়া নামে প্রতিষ্ঠিত।

মেজর জিয়া ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক, রনাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সেনাপ্রধান এবং বাংলাদেশের একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য স্বাধীনতাত্তোর মুজিব সরকার বীরোত্তম খেতাবে ভূষিত করেন জিয়াকে।

মেজর জিয়ার ডাক নাম কমল। তার জন্ম বগুড়া জেলার গাবতলীর বাগবাড়ী গ্রামে ১৯৩৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি।

তিনি ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট অফিসার হিসেবে ১৯৫৩ সালে যোগদান করেন। জিয়া ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে খেমকারান সেক্টরে একটি কোম্পানীর কমান্ডার হিসেবে অসীম বীরত্বের পরিচয় দিয়ে ভারত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে জয়লাভ করেন। এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য জিয়াউর রহমান পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে ‘হিলাল-ই-জুরাত’ খেতাবে ভূষিত হন। এছাড়াও জিয়াউর রহমানের ইউনিট এই যুদ্ধে বীরত্বের জন্য দুটি সিতারা-ই-জুরাত এবং নয়টি তামঘা-ই-জুরাত মেডাল লাভ করে। মেজর হিসেবে ১৯৬৯  সালে জয়দেবপুরে সেকেন্ড ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমমেন্ট সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। মেজর জিয়া ১৯৭০ সালে চট্রগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদে দায়িত্ব লাভ করেন।

বাংলাদেশের সর্বত্র সেই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিক্ষোভের ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। এরমধ্যে ১৯৭০ সালের  নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পাকিস্তানি প্রশাসন নির্বাচনের ফল মানেনি। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি প্রশাসন বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ  অস্ত্রশস্ত্র আর গোলাবারুদ মজুদ করার পাশপাশি রাতের অন্ধকারে বিহারী তরুনদের  সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। পাকিস্তানিদের সামরিক প্রস্তুতি দিন দিন বৃদ্ধি পেতে শুরু  করলো এবং প্রতিদিন পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে নতুন সৈন্য আমদানি করা হত। এরমধ্যে মুজিবের আহবানে ১লা মার্চ থেকে সারাদেশে ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। বিহারীরা  বাঙ্গালীদের মিছিলে হামলা, দোকানপাট ও বাড়ীঘরে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাটসহ নির্বিচারে হত্যার ঘটনা ঘটতে থাকে। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব ভাষন দিলেন। ১৩ই মার্চ শুরু হলো ইয়াহিয়ার সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা। বাঙ্গালীরা আশা করেছিল পাকিস্তানি নেতারা যুক্তি মানবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

বিপরীতে বাংলার জনগনের সামনে এলো ২৫শে মার্চের ভয়াল কাল রাত। স্বাধীনতা ঘোষণার আগেই ১৯৭১ সাল ২৫শে মার্চ শেখ মুজিব বাসা থেকে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। গ্রেফতারের আগে মুজিবের কাছ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণার নির্দেশ পাননি কেউ এবং মুজিব নিজেও স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি। মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের কোনো প্রস্তুতি ছিলো না। প্রস্তুতি থাকলে ২৫ মার্চ ও তার পরদিন এত প্রাণহানির ঘটনা ঘটত না। ২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন সাহেব মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। তাজউদ্দীন সাহেব তাকে স্বাধীনতার একটি লিখিত বার্তা রেকর্ড করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু মুজিব তার কথায় সম্মত হননি। উত্তরে মুজিব বলেন, ‘আমার বার্তা প্রচার হলে এবং পাকিস্তানিরা তা শুনলে তারা আমাকে দেশদ্রোহী বলবে। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে চরম সত্য ও বাস্তবতা হলো, ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর, মেজর জিয়া যে কাজটি করতে পেরেছিলেন, তা করা উচিত ছিল জাতীয় পর্যায়ের প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের এবং এর জন্য তাঁদের একটা পূর্বপরিকল্পনাও থাকা প্রয়োজন ছিল। সেই সঙ্কটময় মূহর্তে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষনার ভাষণটি বিভ্রান্ত ও নেতৃত্বহীন জাতিকে শক্তি ও সাহস যোগায়।

মেজর জিয়ার ঘোষণায় মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে, হ্যাঁ এইবার বাংলাদেশ সত্যিই একটা যুদ্ধে নেমেছে।

(সুত্রঃ বই ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’; মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপতি এ কে খন্দকার)।

২৫শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হামলার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে ১৯৭১ সালেই শহীদ জিয়ার নেতেৃত্বের স্ফুরণ ঘটেছিলো। তার উত্থান ছিল নাটকীয়তায় ভরা। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ অধিনায়ক মেজর জিয়ার নেতৃত্বে ২৫ মার্চের মধ্যরাতে অষ্টম বেঙ্গলের বাঙ্গালি সদস্যরা বিদ্রোহ করলে, তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন। একটা চরম মুহূর্তে জিয়াউর রহমান সিদ্ধান্তটি নিতে পেরেছিলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, ক্যাপ্টেন সাদেক হোসেন, লে. শমসের মবিন চৌধুরী, লে. মাহফুজুর রহমান এবং অষ্টম বেঙ্গলের অন্যান্য বাঙ্গালি সদস্যরা ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন।

(সূত্রঃ বই ‘বিএনপি সময়-অসময়’; মহিউদ্দিন আহমদ)।

মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ প্রতিবেদনে মেজর জিয়ার প্রশংসা করার পাশাপাশি এ কথাও বলা হয়, ‘’একজন পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন‘’ (মার্কিন সিআইএ দলিল: প্রথম আল প্রথম আলো, ০৮-১২-২০১২)।

‘তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা’ গ্রন্থে তাজউদ্দীন আহমদের যুদ্ধযাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শারমিন আহমদ। তার বর্ণনায় তিনি বলেন, পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী আব্বু স্বাধীনতার ঘোষণা লিখে নিয়ে এসেছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে এসেছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘোষণায় স্বাক্ষর প্রদানে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান। কথা ছিল যে, মুজিব কাকুর স্বাক্ষরকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে রুপসী বাংলা) অবস্থিত বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে এবং তাঁরা গিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। ২৫শে মার্চের ভয়াল কাল রাতে মুজিবের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়ে শারমিন আহমদ আরও লিখেছেন, মুজিব কাকুর তাৎক্ষণিক এই উক্তিতে (বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো প্রসঙ্গে) আব্বু বিস্ময় ও বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। শারমিন আহমদ তার বর্ণনায় আরও বলেন, সঙ্কটময় মূহর্তে মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষনা শুনে তাজউদ্দিন আহমদ ও দেশ অসহায় মানুষ অনুপ্রাণিত হন।

কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বলেন, স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নন, তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান (শীর্ষ নিউজ ডটকম)। মেজর জিয়ার ঘোষণাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের তুর্যধ্বনি। এই ঘোষনা শুনে পাকিস্তানিদের আকস্মিক হামলায় হতভম্ব জাতি পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সেদিনের সেই রুখে দাঁড়ানো থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর (টাইমস অব ইন্ডিয়া)।

১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এমন মন্তব্য করে বিশিষ্ট কলামিস্ট ও সমালোচক ফরহাদ মজহার বলেছেন,

আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। ইতিহাস এটাই। আপনি যতই ইতিহাস লেখেন আর আদালতের রায় দেন কিন্ত তাতে কোনো কাজ হবে না। কারন শেখ মুজিবুর রহমান তখন গ্রেফতার হয়ে পাকিস্তানের কারাগারে। তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দেননি।

জিল্লুর রহমানের উপস্থাপনায় টেলিভিশন চ্যানেল আই ‘তৃতীয় মাত্রায়’ সাবেক ডাকসু ভিপি ও বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাবেক সংসদ সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদ বলেছেন, অপ্রিয় হলেও সত্য, ২৭শে মার্চ আমি নিজে শুনেছি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছিলেন’ এটা আমাকে স্বীকার করতে হবে।

চ্যানেল আই ‘তৃতীয় মাত্রায়’ অন্য এক আয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠন, চার খলিফার একজন ও সাবেক সংসদ সদস্য নূরে আলম সিদ্দিক বলেন,

মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ জিয়াই ছিলেন।

উপরিউক্ত গবেষণা লব্ধ তথ্য ও বিশিষ্ট বিশ্লেষকদের বক্তব্য থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, শহীদ জিয়া সংকট মূহুর্তে শুধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, সেক্টর কমান্ডার হিসেবে রনাঙ্গনে যুদ্ধে নেতৃত্বও দেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সাথে শহীদ জিয়ার নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। সুতরাং কখনোই স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ থেকে জিয়াকে বিচ্ছেদ করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের অবদান অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে অস্বীকার করা হলে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অস্বীকার করা হবে। এটাই সত্য ও ইতিহাস। ইতিহাস তার নিজস্ব গতিতে চলে। শাসকদলের দুর্নীতি ও দুশাসন এবং গনতন্ত্রহীন বর্তমান সংকটময় মুহুর্তে বিজয়ের মাসে মহান স্বাধীনতার ঘোষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। এই মহান জাতীয়তাবাদী বীরকে আল্লাহ জান্নাত দান করুন। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও বাংলাদেশের জাতীয় বীরদের সাহসিকতা ও মহত্বের করণেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ চার যুগেও টিকে আছে। আর কতদিন কিভাবে টিকবে, সে ভাবনা এখন মুখ্য হয়ে দাড়িয়েছে।

  • লেখক, সিনিয়র সায়েন্টিস্ট নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।

জিয়া লাইব্রেরী অনলাইন
Logo