জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : পাঁচ বছরে জেনারেল জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে অন্তত কুড়িটির বেশি ব্যর্থ অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল। জেনারেল জিয়া প্রত্যেকটিই দমন করেছিলেন শক্ত এবং নির্মম হাতে। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে জেনারেল জিয়ার চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। তাকে নিযুক্ত করা হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব জার্মানিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন মাত্র মন্ত্রী অল্প সময়ের জন্য প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নুরুল ইসলামকে ২৫ মে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে এনে প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব দিয়েছিলেন। জুলাই মাসে জেনারেল জিয়া আরেকটি মাস সেনাবাহিনীতে থাকতে চেয়ে রাষ্ট্রদূত হিসেবে যেন কোনো কমিউনিস্ট দেশ নয়, অন্য কোনো ধনবাদী দেশে নিয়োগ দেওয়া হয়, এমন আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলামের কাছে। এর আগে জেনারেল সফিউল্লাহকে আরও তিন বছরের জন্য সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে জিয়া বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন এবং পদত্যাগপত্র জমা দেন। কিন্তু তৎকালীন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম পদাতিক বাহিনীর কাঠামোবিন্যাসে জিয়াকে আরও কিছুদিন প্রয়োজন- জানিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেন, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ এ পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে রাষ্ট্রপতির কাছে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দেবেন।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর নৃশংসতা আর খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখল জেনারেল জিয়ার জীবন একেবারে পাল্টে দেয়। ২৪ আগস্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেন আর সফিউল্লাহকে করেন রাষ্ট্রদূত; অর্থাৎ যা ঘটার কথা ছিল জিয়ার জীবনে তা ঘটল সফিউলল্গাহর জীবনে। চিফ অফ ডিফেন্স পদ সৃষ্টি করে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে তিন বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব দেন মোশতাক। তার ওপর জেনারেল ওসমানীকে করেন প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা।
২.
২৫ জুলাই ১৯৭১-এ মেজর তাহের, মেজর মন্জুর, মেজর জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়ে গুরুতর আহত হয়ে তাহের মুক্তিযুদ্ধে পা হারান। যুদ্ধাহত এই সতীর্থের সঙ্গে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসভঙ্গের নিদর্শন রেখে গেছেন জেনারেল জিয়া। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জিয়া যখন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফের অনুগত সেনাদের হাতে বন্দি, খালেদ মোশাররফের পাল্টা অভ্যুত্থানে হারিয়েছেন সেনাপ্রধানের পদ, ঠিক সেই সময়ে কর্নেল তাহের তার অনুগত সৈনিকদের নিয়ে জিয়ার পাশে দাঁড়ান। জিয়াকে মুক্ত করেন। কর্নেল তাহের জিয়াকে সামনে রেখে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন। জিয়া সে পথে যাননি। গিয়েছিলেন ঠিক তার উল্টো দিকে। সাম্প্রদায়িকতার পথে, পুঁজিবাদের পথে। কর্নেল তাহেরকে ১৯৭৬ সালের ২১ জুলাই খুবই সংক্ষিপ্ত এক বিচারে, সামরিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করে ফাঁসি দেওয়া হয়। যে আইনে তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়, সেই সময়ে সেই আইন বাংলাদেশে ছিল না। তাহেরের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার দশ দিন পর অধ্যাদেশ বলে আইনটি প্রণয়ন করা হয়।
ব্যর্থ অভ্যুত্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭-এর অভ্যুত্থান চেষ্টা। মূলত বিমানবাহিনীর ভেতর থেকে এ অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। জিয়ার বাসভবনেও হামলা হয়েছিল। জেনারেল জিয়ার অনুগত সৈন্যরা তা প্রতিহত করে। এক হাজার ১৫৭ জন সেনা কর্মকর্তার ‘বিচার’ ও মৃত্যুদণ্ড হয় তখন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জেনারেল জিয়া নিজের ক্ষমতা আরও সংহত করতে রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতি হয়ে যান। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সেনাবাহিনীর প্রধান তিনটি পদেই আসীন হন। রাষ্ট্রপতি হয়ে জেনারেল জিয়া ২২ এপ্রিল ১৯৭৭-এ সংবিধানে হাত দেন। ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ স্থলে আনেন ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ’। যেন শুধু রাষ্ট্র গঠনের জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, আর কোনো স্বপ্ন ছিল না। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার স্থানে নিয়ে আসে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার’। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মুখটা পাকিস্তানের দিকে ঘুরে যায়। গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে ফেলে আসা পাকিস্তানের দিকে।
রাজনীতির দিকে এগিয়ে যান জেনারেল জিয়া। দল গঠন প্রক্রিয়া শুরু করেন। বাংলাদেশ সৃষ্টির সময় বাংলাদেশ-বিরোধী মুসলিম লীগ, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর বেশ কিছু সদস্য, পিকিংপন্থি ভাসানী ন্যাপের মশিয়ুর রহমান যাদু মিয়াসহ আরও কিছু শক্তিকে তিনি তার রাজনৈতিক দলে ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতাকেও তার দলে ঠাঁই দেন। দলটি স্লোগান দিতে শুরু করে ‘রুশ-ভারতের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’। স্লোগানটি তাদের বিরুদ্ধে, যে দুই দেশ মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা রেখেছিল।
৩.
জেনারেল জিয়ার সঙ্গে সেনাবাহিনীতে থাকা মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের দূরত্ব ক্রমশই বাড়তে থাকে। তার অন্যতম সমর্থক ছিলেন জেনারেল মন্জুর। জেনারেল জিয়া তাকে সিজিএসের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে চট্টগ্রামের জিওসি হিসেবে নিয়োগ দেন। ১৯৭১ সালের ১৩-১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান রক্ষার জন্য যে শাহ আজিজুর রহমান ভুট্টোর সঙ্গে জাতিসংঘে দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন, সেই শাহ আজিজকে জিয়া ১৯৭৯ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ‘নির্বাচনে জয়লাভ’ করিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। দালাল আইনে শাহ আজিজকে যুদ্ধের পর জেল খাটতে হয়েছিল। তিনিই হয়ে যান ত্রিশ লাখ শহীদের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী! একপর্যায়ে পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে যায় যে, জিয়ার চারপাশের মুক্তিযোদ্ধারা তার পাশ থেকে ছিটকে দূরে সরে যেতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধারা তার ওপর ক্ষুব্ধ হতে থাকেন।
৩০ মে রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে লে. কর্নেল মতিউর রহমান জিয়ার ওপর চায়নিজ স্টেনগান চার্জ করেন। কর্নেল মতিউর রহমান একাত্তরে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। জেনারেল জিয়া জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ করে, তার সমালোচনা করে কোনো বক্তৃতা দেননি। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ যে স্বাধীনতার ঘোষণাটি তিনি পাঠ করেন, সুতরাং তিনিই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছেন, এমন দাবিও জিয়ার ছিল না।
১৯৮০ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতে আবার সরকার গঠন করলে জেনারেল জিয়া ১৯৮১ সালের জানুয়ারি মাসে ভারত সফরে যান। সেই সময়ের ডানপন্থি ইত্তেহাদ পত্রিকা খবর প্রকাশ করে, মিসেস গান্ধীর দুটি শর্ত জেনারেল জিয়া মেনে নিতে বাধ্য হন। তার একটি হচ্ছে- শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচার, অপরটি মুজিবকন্যাকে দেশে ফিরতে দেওয়া। জিয়া হত্যার ১৩ দিন আগে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন। জাসদকে জেনারেল জিয়া ভারতের মদদপুষ্ট দল মনে করতেন। কেন মনে করতেন সেই কারণ অজানা। জাসদ নেতাদের বড় অংশকে সাধারণ ক্ষমায় তিনি মুক্তি দিয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুই তাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়ী আসন করে দেয়। তার মৃত্যুর পর তার দলটি আরও দক্ষিণপন্থার দিকে হেঁটেছে। এখনও অনেকে তার প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলটিকেই আওয়ামী লীগের বিকল্প শক্তি হিসেবে মনে করে।