৩০ লক্ষ শহীদ, ইতিহাসের বিশ্লেষণে

জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের নির্দেশে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-নামে পাকিস্তানি সেনারা রাজধানীর রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, রোকেয়া হলের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারসহ ঢাকার নিরীহ বাঙালির ওপর গণহত্যা চালায়। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে স্থগিত করার আগে বাঙালিদের শায়েস্তা করার বহু পরিকল্পনা করা হয়েছিল পাকিস্তানের রাজধানীতে বসবাসকারী সামরিক শাসকদের পক্ষ থেকে।
‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মূল পরিকল্পনায় ছিলেন ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। তাদের সরাসরি নির্দেশে চলে বাঙালির ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত গণহত্যা। সেই সঙ্গে ২৬ মার্চের মধ্যে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান বড়ো বড়ো শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর উদ্দেশ্যই ছিল বাঙালি পুলিশ, বিডিআর আর সামরিক বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসররা বাঙালির ওপর নৃশংসভাবে হত্যাকা- চালায়। পাকিস্তানীদের পক্ষে নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা করা সহজ ছিল না। কারণ তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের ভৌগলিক দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতার কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্য-সামন্ত ও রসদের যোগানে প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজমান ছিল।
হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা বাঙালিদের গণহত্যার পর এর চিহ্ন মুছে ফেলতে অসংখ্য লাশ গুম করেছে। তারা বাঙালিদের নির্যাতন ও হত্যার জন্য বিশেষ বিশেষ স্থান বেছে নিয়েছিল। হানাদার বাহিনী বাঙালি হত্যায় সব সময় বুলেটও ব্যয় করেনি। তারা কখনও বেয়োনেট দিয়ে, কখনও ধারালো ছুরি দিয়ে নির্মমভাবে মানুষ জবাই করেছে। ময়লার ডিপোতে স্থান পেয়েছে মানবসন্তানের লাশ। হত্যার পর হতভাগা মানুষের মৃতদেহ ফেলে দেয়া হয়েছে খাল-বিল-নদীতে। যেখানে নদী ছিল না সেখানে তারা মৃতদেহগুলো মাটিচাপা দিয়েছে। ফলে হত্যার চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য নদী বা খালে লাশ ফেলে দেয়া ঘাতকদের কাছে সহজ উপায় হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। (সূত্র : বধ্যভূমি-গণকবরগুলো সংরক্ষণ করুন, আর কে চৌধুরী, দৈনিক যুগান্তর ২৩ ডিসেম্বর ২০২০)
যে জায়গাগুলোয় হানাদার বাহিনী বাঙালির ওপর হত্যাকা- চালায় সে জায়গাগুলো ‘মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি’-নামে পরিচিত। অনেক মানুষ হত্যা করে যেখানে কবর, মাটি চাপা দেয়া হয়েছে তা ‘গণকবর’ নামে পরিচিত।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াবহতা নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি মন্তব্য করেছেন, তার সেনাবাহিনীর তখনকার অভিযানগুলোর নৃশংসতা ও হিংস্রতা মোঙ্গল শাসক ও দিগি¦জয়ী চেঙ্গিস খান, হালাকু খানদের নিষ্ঠুরতাগুলোকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।
পাকিস্তানী শাসকরা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরেই অবলোকন করতে পেরেছিল বাঙালির কাছে মুক্তিযুদ্ধ আর কোনো গোপন বিষয় নয়। আর এ যুদ্ধে প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করবেই। ১৯৭০ সালের ৩০ নভেম্বর মওলানা ভাসানীর স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ১ দফা, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে রেসক্রস ময়দানে বঙ্গবন্ধুর শেষ উক্তি ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ শব্দগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে শোনার অপেক্ষায় ছিল পাকিস্তানের শাসকরা। যাতে বিচ্ছিতাবাদী বলে বাঙালিদের হত্যা করা যায়।
রবার্ট পেন তার ম্যাসাকার বইতে লিখেছেন-‘একাত্তর সালেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্নে, অর্থাৎ মার্চে পাকিস্তানে জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রথম বলেছিলেন, ওদের ত্রিশ লাখ হত্যা কর, বাকিরা আমাদের থাবার মধ্যে থেকেই নিঃশেষ হবে।’
মওলানা ভাসানী যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়েই দশ লক্ষ হত্যাকা-ের কথা তার বক্তব্যে বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর খালেদ মোশাররফ কানাডার গ্রানাডা টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ইতিমধ্যে দশ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে’। (সূত্র: যে সমস্ত যুক্তিতে মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ বাহুল্য নয়, আরিফ রহমান, অনলাইন সংবাদপত্র-রাইজিংবিডি.কম ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬)
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এম.আর.আখতার মুকুল চরমপত্রের শেষ পর্বে তিরিশ লক্ষ শহীদের কথা বলেছিলেন।
দৈনিক পূর্বদেশে পত্রিকায় ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ‘ইয়াহইয়া জান্তার ফাঁসি দাও’-শিরোনামে লেখা হয়-‘হানাদার দুশমন বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দু’শতাধিক বুদ্ধিজীবিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।’
রাশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদা পত্রিকা ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি ৩০ লক্ষ শহীদের বিষয়টি তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করে।
১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি তিরিশ লক্ষ শহীদের কথা প্রকাশ করে মর্নিং নিউজ লেখে-ঙাবৎ ৩০ ষধশয ঢ়বৎংড়হং বিৎব শরষষবফ ঃযৎড়ঁমযড়ঁঃ ইধহমষধফবংয নু ঃযব চধশরংঃধহর ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ভড়ৎপবং ফঁৎরহম ঃযব ষধংঃ হরহব সড়হঃযং.
৫ জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকার দৈনিক অবজারভার শিরোনাম করেÑচধশ অৎসু করষষবফ ড়াবৎ ৩০ খধশয ঢ়বড়ঢ়ষব.
৫ জানুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক বাংলা তিরিশ লাখ শহীদের কথা লেখে-‘জল্লাদের বিচার করতে হবে’।
৫ জানুয়ারি ১৯৭২ দৈনিক বাংলার ‘হুশিয়ার আন্তর্জাতিক চক্রান্ত’ শিরোনাম খবরে লেখা হয়, দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশে যে তা-ব চালিয়েছে তাতে ৩৫ লক্ষাধিক বাঙালি প্রাণ হারিয়েছে।
গবেষক রওনাক জাহানও তার গবেষণায় ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যা খুঁজে পেয়েছেন। ১৯৮১ সালের ইউনাইটেড ন্যাশনস হিউম্যান রাইটস কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী মানবসভ্যতার ইতিহাসে যতগুলো গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে তাতে অল্প সময়ের মধ্যে সব থেকে বেশি সংখ্যক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে। প্রতিদিন গড়ে ৬,০০০ থেকে ১২,০০০ মানুষ তখন খুন হয়েছিল বাংলাদেশে। গণহত্যার ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ গড়। তবে এখানে উল্লেখ্য, অপারেশন সার্চলাইটের প্রথম রাতের প্রাণহানির সংখ্যাই ছিল কমপক্ষে ৩৫,০০০। চুকনগর গণহত্যায় প্রাণহানি ঘটেছিল ১০,০০০ এর ওপরে। (সূত্র : ত্রিশ লক্ষ শহীদের সংখ্যাতত্ত্ব, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ২ জানুয়ারি ২০১৬)
২৫ মার্চের গণহত্যার কুখ্যাত নায়ক ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে ১৯৭২ সালের ৩ মার্চ থেকে ১৯৭৫ সালের ১ মার্চ সেনাপ্রধান থাকা জেনারেল টিক্কা খান বলেছেন-‘আমাদের সংগ্রামের সময়, আমরা মাটি চাই, মানুষ নয়।’
বাংলাদেশের গণহত্যার আরেক নায়ক, ষড়যন্ত্রকারী জেনারেল রাও ফরমান আলি খান তার তখন ডায়েরিতে লিখেছেন-‘বাংলার সবুজকে লাল করে দিতে হবে।’ (সূত্র : গণহত্যার নতুন পঞ্জি, সাহাদাত পারভেজ, দৈনিক দেশ রূপান্তর ২০ জানুয়ারি ২০২০)
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা কত ছিল তা যুদ্ধকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম, যুদ্ধের অব্যবহতি পরে দেশী সংবাদমাধ্যম, গ্রহণযোগ্য ইতিহাসের বই থেকেই পরিসংখ্যান জানা যায়। প্রখ্যাত গণহত্যা গবেষক লিও কুপার জেনোসাইড নামে তার বইতে ব্যবহারকৃত প্রচ্ছদে লিখেছেন কোন যুদ্ধে কতজন শহীদ। সেখানে স্পষ্টভাবে লেখাÑ
১৯১৫ : ৮০০,০০০ আর্মেনিয়ান।
১৯৩৩-৪৫ : ৬০ লাখ ইহুদি।
১৯৭১ : ৩০ লাখ বাংলাদেশি।
১৯৭২-৭৫ : ১০০,০০০ হুটু।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বিষয়ক ওয়েবসাইট ফবভবহপব.ঢ়শ-এ প্রকাশিত ঞযব জধফরপধষ ঞৎঁঃয: ঞবধপযরহম গচঅঈটক ঃযব ঋড়ৎমড়ঃঃবহ ঈযধঢ়ঃবৎ ড়ভ চধশরংঃধহ’ং ঐরংঃড়ৎু শীর্ষক নিবন্ধের তৃতীয় অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৭১ সালে ৯ মাস ধরে ইয়াহিয়া খান এবং তার সেনা অফিসাররা স্থানীয় সহযোগিদের সাথে নিয়ে যে গণ-হামলা চালিয়েছে তাতে অসংখ্য নাম না জানা বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন যার সংখ্যা ৩০ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঊহপুপষড়ঢ়বফরধ অসবৎরপধহধ তাদের ২০০৩ সালের সংস্করণে বাংলাদেশ নামক অধ্যায়ে একাত্তরে মৃত মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করেছে ৩০ লাখ। (সূত্র : পরিসংখ্যানই সাক্ষী শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখ-মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধের চেষ্টা করলেই শাস্তি, উদিসা ইসলাম, অনলাইন সংবাদপত্র-বাংলা ট্রিবিউন ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ নেত্রকোনার রাজাকার ওবায়দুল হক (তাহের) ও আতাউর রহমানের (ননী) বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের শহীদ হওয়া ও লাখ লাখ নারীর সম্ভ্রম বিসর্জন প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস। এই ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র আবেগ ও গৌরবের মধ্যে মিশে আছে।’
২৬৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের ৪৪৬তম অনুচ্ছেদে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর কাছ থেকে মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মুক্ত করতে বাঙালি জাতি ও মুক্তিযোদ্ধারা নয় মাস যুদ্ধ করেছেন, এ ইতিহাস তর্কের ঊর্ধ্বে। যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন, লাখ লাখ নারী তাঁদের সর্বোচ্চ সম্মান বিসর্জন দিয়েছেন। এক কোটি মানুষ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে জাতির পবিত্র আবেগ ও গৌরবের মধ্যে মিশে আছে, যে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে।’ (সূত্র : রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল-মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত, নিজস্ব প্রতিবেদক, দৈনিক প্রথম আলো ৩ ফেব্রুয়ারির ২০১৬)
২০১৫ সালে একটি জাতীয় দৈনিক সরকারি হিসাবের বরাত দিয়ে দেশে মোট ২০৯টি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধানের তথ্য প্রকাশ করে। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ১৯৩টি শনাক্ত করেছে। তবে বলা হয়েছে-বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরো বেশি। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং-এর তথ্যে ৭১ সালে দেশে প্রায় ৫ হাজার ছোটো-বড়ো বধ্যভূমি ছিল। এর মধ্যে সারা দেশে ৯২০টি শনাক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া ৮৮টি নদী ও ৬৫টি ব্রিজ-কালভার্ট শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলোতে শত শত বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। রাজধানীতে ৭০টি বধ্যভূমির মধ্যে মিরপুরেই রয়েছে ২৩টি। কিন্তু ২৩টি বধ্যভূমির মধ্যে সংরক্ষিত হয়েছে মাত্র তিনটি। অযতœ ও অবহেলায় দেশের বধ্যভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। (সূত্র : অবহেলায় অরক্ষিত বধ্যভূমি, জিন্নাতুন নূর, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন ১ ডিসেম্বর ২০১৫)
২০১৮ সালের ৩১ মার্চ বাংলা একাডেমিতে ‘গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ’-শীর্ষক দিনব্যাপী এক সেমিনারে ১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্টের খুলনা, রাজশাহী, নীলফামারী, বগুড়া, নাটোর, কুড়িগ্রাম, পাবনা, সাতক্ষীরা, নারায়ণগঞ্জ ও ভোলা জেলায় পরিচালিত জরিপের তথ্য তুলে ধরা হয়। এ জরিপের উপর ভিত্তি করে ১০ জেলার নামে আলাদা করে ‘গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ’ নামে ১০টি বই প্রকাশ করেছে ‘গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধি বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র’।
জরিপের তথ্য তুলে ধরে ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘বিভিন্ন বইয়ে সারাদেশে গণহত্যার সর্বোচ্চ সংখ্যা পাওয়া যায় ৯০৫টি। কিন্তু জরিপে ১০ জেলাতেই এক হাজার ৭৫২টি গণহত্যার ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। আর গণহত্যার স্থানের সঙ্গে বধ্যভূমি ও গণকবর মিলিয়ে ১০ জেলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ১০৭টি। দশ জেলায় সংখ্যা যদি হয় ২ হাজার ১০৭টি, তাহলে ৬৪ জেলায় সে সংখ্যা কত দাঁড়াতে পারে? শহীদের সংখ্যা কি ৩০ লাখে সীমাবদ্ধ থাকে?’
মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘জরিপে গণহত্যার সঙ্গে বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্র চিহ্নিত করার কাজও করা হচ্ছে। আগের বইপত্রগুলোতে খুলনার গণহত্যাকে ক্রিসেন্ট জুট মিল হত্যাকা- হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের যুক্তি হচ্ছে, সেখানে তো একদিন গণহত্যা চালানো হয়নি। প্রায় প্রতিদিন হয়েছে। সুতরাং প্রতিবার হত্যাকেই আলাদা হিসেবে ধরেছি আমরা।’
এই হিসেবে সেখানে যুদ্ধের ২৬০ দিনে গণহত্যার সংখ্যা একটি না ধরে ১০০টি ধরা হয়েছে বলে জানান তিনি। জরিপে দশ জেলার মধ্যে গণহত্যার সবচেয়ে বেশি ঘটনা পাওয়া গেছে খুলনায়; সেখানে ১ হাজার ১৫৫টি গণহত্যা, ২৭টি বধ্যভূমি, ৭টি গণকবর এবং ৩২টি নির্যাতন কেন্দ্রের তথ্য পাওয়া গেছে। আগের গবেষণাগুলোতে নীলফামারীতে ৫-৬টি জায়গায় গণহত্যার কথা বলা হলেও এবারের জরিপে উত্তরের এ জেলায় গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৫টিতে।
এছাড়া রাজশাহীতে ১৮টির জায়গায় ২৬২টি, বগুড়ায় ১৪টির জায়গায় ১৩৯টি, নাটোরে নয়টির জায়গায় ১২৬টি, কুড়িগ্রামে সাতটির জায়গায় ৮৪টি, পাবনায় ২১টির জায়গায় ১২৬টি এবং সাতক্ষীরায় সাতটির জায়গায় ৪১টি গণহত্যা, বধ্যভূমি, গণকবর ও নির্যাতন কেন্দ্রের তথ্য এসেছে এই জরিপে। নারায়ণগঞ্জ ও ভোলায় এই সংখ্যা পাওয়া গেছে যথাক্রমে ২৮৮ ও ৭৪টি করে। (সূত্র : জরিপে একাত্তরের গণহত্যার নতুন তথ্য, আরটিভি অনলাইন ৩১ মার্চ ২০১৮)
বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের পক্ষে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছিল ২০০৯ সালে। অবশ্য এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ৩৫টি বধ্যভূমি ও স্মৃতিবিজড়িত স্থান সংরক্ষণ করতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু এ কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। দেশে তো আরো অনেক এরূপ স্থান রয়েছে। আদালতের রায়ের পর ২০১০ সালের শেষ দিকে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সারা দেশের ২০৪টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু ওই চিহ্নিত করা পর্যন্তই। সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগে রয়েছে ধীরগতি।

জিয়া লাইব্রেরী অনলাইন
Logo