জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে?’ বিষয়ের ওপর ২০০৪ সালে একটি শ্রোতা জরিপের আয়োজন করে বিবিসি বাংলা। সেই জরিপে শ্রোতাদের ভোটে শ্রেষ্ঠ বাঙালির তালিকায় ১৯তম স্থানে আসেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।
আজ শুক্রবার তার জীবন-কথা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা।
প্রতিবেদনটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে দেয়া হলো-
বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে জিয়াউর রহমানের আর্বিভাব হয়েছিল হঠাৎ করেই ১৯৭১ সালে। তার কণ্ঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সেই সময় দেশটির এক প্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে মানুষের মনে সাহস জাগিয়েছিল, সৃষ্টি করেছিল প্রেরণা।
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি বগুড়া জেলার গাবতলী উপজেলায় বাগবাড়ি গ্রামে।
তার বাবা মনসুর রহমান ছিলেন কলকাতায় একটি সরকারি দফতরের কেমিস্ট। ভারত ভাগ হওয়ার পর তিনি করাচি বদলি হয়ে গেলে জিয়াউর রহমান সেখানেই একাডেমি স্কুলে পড়াশোনা করেন।
করাচিতে লেখাপড়া শেষ করে তিনি ১৯৫৩ সালে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন একজন ক্যাডেট অফিসার হিসেবে।
জিয়াউর রহমান ১৯৫৫ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হওয়ার পর সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা শাখাসহ বিভিন্ন বিভাগে কাজ করেছেন।
বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর আগে ১৯৭০ সালে তিনি চট্টগ্রাম সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে সহঅধিনায়ক হিসেবে বদলি হন।
তখনই জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন বলে তার ওই রেজিমেন্টের সহকর্মী কর্নেল অলি আহমেদ জানিয়েছেন।
অলি আহমেদ বলেন, প্রায় সময় দেখতাম তিনি দেশের ব্যাপারে খুব চিন্তিত থাকতেন। একপর্যায়ে তিনি আমাকে বললেন, নির্বাচনের পর পাকিস্তান থেকে নতুন সেনা দল আসছে, অস্ত্র আসছে। মনে হয় পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সদস্যরা শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে না বা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। এতে আমাদের কী করণীয়?
‘এর একপর্যায়ে আমরা বিদ্রোহের পরিকল্পনা করলাম।’
কর্নেল ওলি আহমেদ বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের ঘটনার পর অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা বিদ্রোহ করেন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে।
‘২৫ মার্চ রাতে যখন আমরা শুনলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনী বর্বর ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সমগ্র ঢাকাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে, চট্টগ্রাম থেকে একমাত্র তখন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আমরা বিদ্রোহ করি।’
তিনি বলেন, পরবর্তী পর্যায়ে ২৭ তারিখ আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, জিয়া দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। এবং তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন।
তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দলিলের তথ্যমতে, কয়েকজন ব্যক্তি ২৬ ও ২৭ তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানও তার ঘোষণাটি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের নামে পাঠ করেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের একটা মানুষের ঘোষণার অধিকার ছিল, আর তিনি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এটি নিয়ে যে বিতর্ক আসতে পারে, সেটিই তো কেউ কখনও চিন্তাও করেনি।
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৯৮২ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র ৩য় খণ্ডে বলা হয়েছে– ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটকের আগেই শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে একটি তারবার্তা পাঠান।
এতে বলা হয়, ২৫ মার্চে মধ্যরাতের পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে এ ঘোষণা দেন তিনি, যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
পরে চট্টগ্রামের স্থানীয় একটি বেতারকেন্দ্র থেকে ২৬ ও ২৭ মার্চ বেশ কয়েকজন শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন।
জিয়াউর রহমান প্রথমে সেক্টর কমান্ডার এবং পরে জেড ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে স্বাধীনতাযুদ্ধ করেন। স্বাধীনতালাভের পর ১৯৭২ সালে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান করা হয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, পঁচাত্তরে যেসব পটপরিবর্তন হচ্ছিল, সেই পটভূমিতে বাধ্যতামূলকভাবে পদত্যাগ করা এবং আটক অবস্থায় থাকা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে এনে ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল।
আর সেভাবেই একজন সামরিক কর্মকর্তা পরবর্তী সময় জনপ্রিয় রাজনীতিক হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন বলে মনে করেন এমাজউদ্দীন আহমদ।
তিনি বলেন, জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে এলেন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতা বিপ্লবের মাধ্যমে। তবে এই বিপ্লব অবশ্য তার ইনিশিয়েটিভে (উদ্যোগে) হয়নি, এই বিপ্লবের অন্য কারণ ছিল। কিন্তু এটি বলতে পারি যে, এই বিপ্লবের ফলশ্রুতিই বরং তাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুখ্য ভূমিকা পালনের জন্য ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিল।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আরও বলেন, জিয়াউর রহমান বড়মাপের নেতা হওয়া বা জনপ্রিয়তা পাওয়ার মূল কারণ ছিল, তিনি তার দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সব দলের রাজনীতি করার সুযোগ সৃষ্টি করেছিলেন।
‘জিয়াউর রহমান সাহেব অনুভব করেছিলেন যে একটি দেশকে ভালোভাবে শাসন করতে হলে দল গঠন অপরিহার্য। আর বিশেষ করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বহু দল তো অপরিহার্য। এই বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের লক্ষ্যে তিনি প্রথমে এক্সিসটিং (সেই সময় কার্যকর) দলগুলোকে স্বীকৃতি তো দিলেন, এবং সেই সঙ্গে নিজের দল করলেন ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর।’
নিজের দেশের রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে সার্ক জোট গঠনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখাসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও জিয়াউর রহমান নিজের একটা অবস্থান করে নিয়েছিলেন।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ বলেন, জিয়াউর রহমানকে যেদিক থেকেই বিবেচনা করা হোক না কেন, তিনি যে বাঙালি জাতির অন্যতম একজন শ্রেষ্ঠ সন্তান সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
‘১৯৮১ সালের ৩০ মে একটি দুঃখবসহ ঘটনার দিন। তিনি হয়তো দলীয় অথবা জাতীয় কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রামে যখন তিনি নৃশংসভাবে নিহত হলেন তার সহযোগী, সামরিক বাহিনীরই কিছু কর্মকর্তার হাতে, তখন সেই সংবাদ কিন্তু গোটা দেশ খুব কষ্টের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই বিএনপি দল হিসাবে টিকে রয়েছে।