জিয়াউর রহমান যেভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন

জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : হাজার বছরের শোষণ, বঞ্চনা ও পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ১৯৭১ সালের এদিনে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। ইতিহাসের পৃষ্ঠা রক্তে রাঙিয়ে, আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করে সেদিন থেকে দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার চূড়ান্ত পরিণতি। সেই রক্তয়ী সংগ্রামের গৌরব ও অহঙ্কারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দিন আজ। ভয়াল ২৫ মার্চ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘুমন্ত নিরস্ত্র মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালায়।

পৃথিবীর ইতিহাসে বর্বরতম এই গণহত্যা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত। পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হওয়ার পর প্রায় ২১৪ বছর ধরে স্বাধীনতার স্বপ্ন বুকে লালন করে রেখেছিলাম আমরা। অথচ চির আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতার লালসূর্যটি যখন নির্যাতন ও দুঃশাসনের কালো মেঘের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছিল ঠিক সেই সময় জাতির ভাগ্য অনিশ্চতার মধ্যে ঠেলে দিয়ে প্রলয় আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে এ জাতির তথাকথিত রাজনীতিবিদ সিংহশাবকরা অনেকেই আত্মগোপন করেছিলেন। তাদের কেউ যায় বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে গগনদের বাড়িতে, কেউ যায় ওপারে। : ২৪ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা সামরিক অভিযানের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করতে চায়। সোনার বাংলাদেশকে রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে হানাদার বাহিনী এদেশের জনগণের কাছ থেকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ ল্েয তারা ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল, আরমানিটোলা ও পিলখানায় নির্মম গণহত্যা চালায়। অসহায় নিরীহ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ করে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করা হয়। ঘরে ঘরে ধর্ষণ ও লুটপাট চলে।

 

বিপন্ন মানুষের আর্তচিৎকার সেদিন আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হলেও হানাদার বাহিনীর হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেনি। মুহুর্মুহু গোলাবারুদের বিস্ফোরণে রাজধানী ঢাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালের এইদিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগের পূর্বে তিনি সেনাবাহিনীকে গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে যান। তার ঢাকা ত্যাগের আগে দিনের বেলায় রংপুর ও সৈয়দপুরে বেশ কয়টি জায়গায় স্বাধীনতাকামী ছাত্র-জনতাকে হত্যা করা হয়। এদিন সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে বিলম্ব হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং হত্যাকান্ডকে দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করেন। : বিবৃতিতে শেখ মুজিব বলেন, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি এবং রাজনৈতিক সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ সদিচ্ছা দেখিয়েছি। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার উপদেষ্টারা বিষয়টির রাজনৈতিক সমাধান চাইলে তাদের সেদিকেই যেতে হবে। তিনি দেশের বিভিন্নস্থানে নির্যাতন ও গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন। ২৫ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতিকে কোনো দিক-নির্দেশনা না দিয়েই শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানিদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী শেখ মুজিবকে করাচিতে নিয়ে যায়।

: মুহূর্তের মধ্যেই নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে জনগণ। নিজের বাঁচার পথ নিজেকেই বেছে নিতে হয়। নেতৃত্বহীন মানুষ সামনে এগিয়ে চলে। পেছনে পড়ে থাকে তথাকথিত রাজনীতিবিদদের পরিচ্ছন্ন পোশাক। অসীম সাহস, সুগভীর দেশপ্রেমের প্রচন্ড বাতাসে কালো মেঘ সরিয়ে জন্ম জন্মান্তরের প্রত্যাশিত স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে (আজকের স্বাধীনতার শোল এজেন্ট বলে দাবিদার গোষ্ঠী) ব্যর্থ হলে জাতি পুনরায় অনাদিকালের জন্য পরাধীনতার নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ার উপক্রম হয়। এমনি এক অনিশ্চয়তা ও ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যে ৫৫,৫৯৮ বর্গমাইলের বনি আদমেরা যখন বাকরুদ্ধ, শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রহর গুনছে, জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচবে নাকি জীবন দিয়ে প্রতিরোধ করবে-বুঝে উঠতে পারছে না। আশা দেবার, ভরসা দেবার, সান্ত¡না দেবার যখন আর কেউ এগিয়ে আসছে না, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে ঠিক এমনি এক অমানিশার ঘোর অন্ধকারে বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলসে উঠলো প্রকৃতি ও মানুষ। বাতাসের প্রতিটি তরঙ্গে কান পেতে সবাই শুনলো-‘উই রিভোল্ট’। প্রতিরোধের মশাল জ্বলে ওঠে চট্টগ্রামের ষোল শহরের অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের প্রাণপ্রিয় নেতার ডাকে। ৩৫ বছরের এক ‘মেজর’ নিজ দায়িত্বে ঘোষণা করেন বিদ্রোহ। এটিই স্বাধীনতার পে প্রথম বিদ্রোহ। : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রথম বিদ্রোহ করেন সেটি ছিলো অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের খেলার মাঠ।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এই মাঠে দাঁড়িয়েই অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের জড়ো করে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান সর্বপ্রথম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। যে তিনটি জিনিসকে সম্বল করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সেদিন সংগ্রামের শপথ নিয়েছিলেন তা হলো-আল্লাহতায়ালার প্রতি অগাধ বিশ্বাস, সংগ্রামী জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা ও সৈনিকদের আত্মবিশ্বাস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তার সঙ্গে ছিলো মাত্র তিনশটি থ্রী নট থ্রী রাইফেল, ১২টি এলএমজি, ৬টি মর্টার এবং ২টি ‘রিকয়েললেস’ রাইফেল। ২৫ মার্চ তাদের সৈনিক সংখ্যা ছিলো মাত্র ২৫০ জন। তাদের সকলের মনেই একটা ভয়ানক উৎকণ্ঠা এবং সচকিত মনোভাব বিরাজ করছিল সেদিন। তারা সবাই, একটা নির্দেশের প্রত্যাশায় ছিল, কিছু একটা ঘটার প্রতীায় ছিল। ২৫ মার্চ রাত আনুমানিক ১১-৩০ মিঃ। একমাত্র আল্লাহকে ভরসা করে এবং নিজের ও সহকর্মীদের জীবনকে বাজি রেখে সমগ্র ব্যাটালিয়নের কর্তৃত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ জিয়া জানিয়ে দিলেন যে, তারা এই মুহূর্ত থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করছেন এবং স্বদেশকে স্বাধীন করার জন্যে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। সবাই বুঝতে পারলো চুপসে গেলে চলবে না, জ্বলে উঠতে হবে।

দিকভ্রান্ত জাতি খুঁজে পায় পথ। ফিরে পায় আত্মবিশ্বাস। এই ঘোষণার মুহূর্তটি ইতিহাসে স্বর্ণারে লিপিবদ্ধ থাকবে। : এরপর ২৬ মার্চ সেই ঘোর অমানিশার মধ্যে অত্যন্ত আকস্মিকভাবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে উজ্জ্বল নত্রের মতো উদয় হলেন জিয়াউর রহমান, কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে। বেতার কেন্দ্রের কর্মীদের সহযোগিতায় তিনিই স্বাধীনতার ঘোষণা উচ্চারণ করলেন। দেশের প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট এবং লিবারেশন আর্মির কমান্ডার ইন চিফ হিসাবে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন,

…আমি মেজর জিয়া প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট এবং লিবারেশন আর্মির কমান্ডার ইন চিফ হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। তিনি এ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহবান জানান। এই ঘোষণা ঐতিহাসিক। এই ঘোষণা প্রত্যয়দীপ্ত। সামনে চলার মানসিকতাপূর্ণ আহবান। সমগ্র জাতি যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মমতায় স্তম্ভিত, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিক-নির্দেশনাহীনতায় সম্বিতহীন সেই বিশৃঙ্খল এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন মুহূর্তে জিয়ার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাই সমগ্র জাতিকে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস যোগায়। সবার মধ্যে এই আস্থা সৃষ্টি করে যে, তিন সপ্তাহব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের পরে সশস্ত্র সংগ্রামের অধ্যায় শুরু হয়েছে। মাটির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা আর দেশপ্রেমের অস্ত্রে তারা পরাস্ত করে প্রবল পরাক্রমশালী পাকবাহিনীকে। গৌরবময় এই বিজয়ের সূচনা জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই। জিয়াউর রহমান একজন সৈনিক, একজন মেজর, একজন জেনারেল, একজন সেনাপ্রধান, একজন রাষ্ট্রপ্রধান এবং সর্বোপরি একজন রাজনীতিবিদ। তিনিই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম বিদ্রোহী। বাংলাদেশের প্রথম প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট এবং প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। নিয়তির অমোঘ পরিণতি ‘মৃত্যু’ ছাড়া তার জীবনে আর কোনো ব্যর্থতা নেই।

জিয়া লাইব্রেরী অনলাইন
Logo