জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : কেউ অস্বীকার করতে চাইলেও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকবে চিরদিন। ক্ষমতায় থাকলে গায়ের জোড়ে অনেক কিছু মেনে নিতে না চাইলেও দেশের প্রতি নিবেদিত একটি প্রানের চেতনাকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। যেমন সম্ভব নয় – শহীদ জিয়াউর রহমানের চেতনাকে বিলীন করে দেয়া। যারা নিয়তিতে বিশ্বাস করেন, তারা অনেকেই হয়তো বলবেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিয়তি শহীদ জিয়াকে এই আসনে বসিয়েছে। নিয়তির কারণে তিনি পরিণত হয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূর্ত প্রতীকে। যারা আজকে তার সেই ভূমিকা নিয়ে কূটতর্ক চালাচালি করেন, আমি নিশ্চিত – তারাও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না—‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ – ’৭১ এর এই ঘোষণাটি তাদেরকে উদ্দীপ্ত করেনি। পঁচিশে মার্চে নেমে আসা অন্ধকারে নিঃসন্দেহে আলো জ্বেলে দিয়েছিল জিয়ার এই ঘোষণা।
নিয়তিতে বিশ্বাস করলে পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য উদাহরণ মিলবে। এটা ঠিক, নিয়তিকে সব সময় যুক্তি-তর্ক দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু নিয়তি কখনোই ইচ্ছা বা মানসিক শক্তির বাইরে কাউকে কোনো আসন দেয় না। যারা নিয়তিতে বিশ্বাস করেন না, তারা বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবেন। বলবেন, তর্কের খাতিরে যদি ’৭১ সালের ঘটনাকে নিয়তির আশীর্বাদ হিসেবে বর্ণনা করা হয়, তাহলে পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশকে বদলে দেয়ার জন্য জিয়ার ভূমিকাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করা হবে?
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একাংশের হাতে বত্রিশ বছর আগে কেন প্রেসিডেন্ট জিয়া নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন? আজ এ প্রশ্নের জবাব অত্যন্ত জরুরি। ১৯৭৫ সালে সিপাহি-জনতার ষড়যন্ত্রবিনাশী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় অভিষিক্ত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তার চিন্তার জগতে শুধু সেনাবাহিনী বা চাকরি নয়—দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিসহ সবকিছু অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। চিন্তার জগতের এই প্রসারতার প্রতিফলন ঘটে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে।
জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছিলেন তারই প্রিয় সহকর্মী ও অনুগতদের হাতে। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। অতীতের ঘটনাবলির পর্যালোচনায় দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর প্রথমটি হচ্ছে ষড়যন্ত্র, অপরটি হচ্ছে সেনানায়ক থেকে তার জননায়কে উত্তরণ। ষড়যন্ত্র তত্ত্বটিকে বহুল আলোচিত মনে হলেও এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবচিত্রের প্রতিফলন। এক্ষেত্রে কথাটিকে ষড়যন্ত্র না বলে একটি রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হওয়াকেও উল্লেখ করা যেতে পারে। জিয়াউর রহমানের একটি বড় অন্যায় ছিল তিনি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন, একটি রাষ্ট্র যদি তার ইচ্ছা অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, তাহলে সে রাষ্ট্রটি সার্বভৌমত্বের মর্যাদা অর্জন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব রাষ্ট্রনায়ক এই নীতি অনুসরণ করেছেন, তাদের অধিকাংশকেই নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাম ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক, পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ইরাকের সাদ্দাম হোসেন। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ আছে। এই একই অপরাধে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে এবং সাম্প্রতিককালে হুমকির মুখে ছিলেন ভেনিজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ।
জিয়াউর রহমান কি ভারত ও আমেরিকা বিদ্বেষী ছিলেন? বিষয়টিকে এত সরলীকরণ করা সম্ভব নয়। উভয় ক্ষেত্রে তিনি চেয়েছিলেন জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন না দিয়ে জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্মাণ করতে। আবার এটাও সত্যি, জিয়াউর রহমানের অনেক সিদ্ধান্তই প্রতিবেশী ভারতসহ অনেকের উষ্মার কারণ হয়েছিল। এই অঞ্চলে ভারত যেহেতু আঞ্চলিক প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়, তাই তার আকাঙ্ক্ষা এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো তাকে গুরু বলে মেনে নেবে। এর পাশাপাশি ভারত তার জাতীয় স্বার্থকেও অনেক বড় করে দেখে। এ কারণেই মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী এখন আর ভারতের মাথাব্যথার কারণ নয়। ভারত এখন মিয়ানমারের সেনাশাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক বেশি তত্পর। জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির স্বাধীন পথচলার কারণে বাংলাদেশ জগত্সভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এর পর আসে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তার অনুসৃত নীতির প্রসঙ্গ। প্রথমে যে বিষয়টি আলোচনা করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে তার জননির্ভর রাজনীতি। সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত না করে তিনি গণরাজনীতিকে উদ্ধার করেন ১৯৭৫-পূর্ব সময়ে পতিত পঙ্কিল আবর্ত থেকে। একই সঙ্গে তিনি নিজেও বেরিয়ে আসেন সেনা প্রভাব থেকে এবং রাজনীতিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন ব্যক্তির কাছে। জিয়াউর রহমানের আগে ব্যক্তি আসত রাজনীতির কাছে। কিন্তু তিনি রাজনীতিকে নিয়ে যান ব্যক্তির কাছে। যেটা রাজনীতিবিদ ও সেনা কর্মকর্তাসহ অনেকের মনোকষ্টের কারণ হয়েছে। এ কারণেই তার খণ্ডিত উদ্ধৃতি ব্যবহার করে তাকে খলনায়ক বানানোর চেষ্টা করেন ওইসব ব্যক্তি, যারা বিভিন্ন কলাকৌশলে জনগণের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চান। বাংলাদেশের সব রাজনীতিবিদের মধ্যে শহীদ জিয়াউর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দেশের লাখো লাখো মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, তাদের দুয়ারে গিয়েছেন, দিন ও রাতে তাদের সুখ-দুঃখের কাহিনী শুনেছেন এবং পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। জন-রাজনীতির যে ধারার সূত্রপাত ঘটে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, ১৯৮১ সালের ৩০ মে – তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই ধারার অবসান ঘটে। জনগণের কাছে পৌঁছতে পেরে জিয়াউর রহমান অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন; স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত যেটা আর কেউ স্থাপন করতে পারেননি। এই জনরাজনীতির উন্মেষই জিয়াউর রহমানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা ও সেনাবাহিনীসহ সমাজের বিভিন্ন সুবিধাভোগী গোষ্ঠী, যারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাদের কাছে জনরাজনীতির বিকাশ হুমকির মত। জিয়াউর রহমান মোহিনী ব্যক্তিত্ব দিয়ে জনগণের মনোজগতকে বদলে দিয়েছিলেন। অবশ্য স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা এক্ষেত্রে প্রভাবকের কাজ করেছে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে জিয়াউর রহমানকে পরিচিত করাতে হয়নি।
নিয়তির বরপুত্র অথবা কর্মের সফল পুরুষ যাই হোক না কেন, তা জিয়াউর রহমানকে যে আসনে বসিয়েছে তা অনেকেরই মনব্যথার কারণ। তারা এখনও জিয়াউর রহমানকে অথবা তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শকে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করেন এবং এ কারণে লাখ লাখ মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের পর সমাহিত এই মানুষটিকে নিয়ে মাথাব্যথার যেন অন্ত নেই। তাই এখনও তার চরিত্র হননের প্রচেষ্টায় একটি মহলে বিশেষভাবে সক্রিয়; যেমনটি তৎপর ছিল পূর্বেও।
অথচ এই মহান নেতার মৃত্যুর পরে ওই সময়ে জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তারেবর আলোচনায় এদেশটির বহু জাতীয় নেতারা বলেছিলেন ভিন্নকথা। সেদিন শহীদ জিয়া যাদের চোখে ছিলেন দেবদূত তুল্য, তারাই স্বার্থের কারণে অকৃতজ্ঞ হয়ে চরিত্র হরণের চেষ্টা চালায় এই মহান নেতার। ১৯৮১ সালের ৩০ মে এর পরে কোন নেতা শহীদ জিয়াকে কিভাবে মূল্যায়ন করেছিলেন, ইতিহাসের পাতাতে সেটাও লেখা থাকবে চিরদিনঃ
আওয়ামী লীগের আসাদুজ্জামান খান :
মরহুম জিয়াউর রহমান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, জাতি সেটা স্মরণ করবে।
তখনকার গণতন্ত্রী পার্টির এমপি ও বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত :
৩০ মে থেকে ৩রা জুন যে লাখ লাখ জনতা শুধু ঢাকা নগরীতেই নয়, গোটা বাংলাদেশে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছে, তার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে, আমাদের সাবেক রাষ্ট্রপতি (জিয়াউর রহমান) বাংলাদেশের মানুষের কত কাছাকাছি এবং প্রাণপ্রিয় ছিলেন। এটা বলতে যদি কেউ কুণ্ঠাবোধ করেন, এটা তার মানসিক দৈন্য এবং তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতার অভাব বলে আমি মনে করি। এই যে লাখ লাখ জনতার স্রোত কেন এসেছিল, এই লাশটির পাশে, কেন এসেছিল জানাজায় ও গায়েবি জানাজায়? এসেছিল একটি মাত্র কারণে—সাবেক রাষ্ট্রপতির সততার প্রতি অভিনন্দন ও শ্রদ্ধা জানাতে। ওই যে কোটি কোটি মানুষের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলে এসেছিলাম এবং যে কথা বলে আমরা বিশ্ববিবেকের সমর্থন পেয়েছিলাম এবং তাকেই আমরা সংবিধানে গৃহীত করেছি।
রাশেদ খান মেনন এমপি :
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়। তাকে সেভাবেই দেখেছি, সেভাবেই সম্মান করেছি। তার যে কীর্তি, সেই কীর্তি অমর এবং অক্ষুণ্ন থাকুক—এটা কামনা করি।
ন্যাপের প্রফেসর মোজাফফর আহমদ :
জিয়াউর রহমান একজন দৃঢ়চেতা, সৎ ও দেশপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন এবং রেডিও মারফত স্বাধীনতার বাণী ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। আমি ঢাকা শহরে আত্মগোপন অবস্থায় ছিলাম। তখন রেডিও মারফতই তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়।
মির্জা গোলাম হাফিজ : মরহুম জিয়াউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ জাগিয়ে তোলার একজন অক্লান্ত কর্মী ও নিবেদিতপ্রাণ। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা সুসংহত ও দেশের গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করার নিমিত্তে তিনি ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজির স্থাপন করেন।
আতাউর রহমান খান : (ঢাকা-১২) হৃদয় আজকে অত্যন্ত ভারাক্রান্ত, বেদনাহত, শোকসন্তপ্ত। কোনো কথা বলার ভাষাই খুঁজে পাচ্ছি না—কী করে এই মর্মবেদনা প্রকাশ করতে পারব।
শাহ আজিজুর রহমান : জিয়াউর রহমান আদর্শ হিসেবে শুধু বাংলাদেশে নয়, দুনিয়ার নিপীড়িত জনগণের জন্য একটি প্রেরণার উত্স হয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন কেয়ামত পর্যন্ত। তিনি ইতিহাসের পৃষ্ঠায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে। তিনিই প্রথম চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।