জিয়া এলেন, দেখলেন, জয় করলেন

জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম ধূমকেতুর মতো উদয় হয়ে মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন। তাকে বাদ দিয়ে একাত্তরের রণাঙ্গনের যুদ্ধ অথবা পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনা সম্পূর্ণ হওয়ার নয়। ৪০টা বছর চলে গেল, তিনি আমাদের মাঝে নেই। তবুও তাকে বাদ দিয়ে কোনো আলোচনা হয় না। তা পক্ষে অথবা বিপক্ষে। তিনি সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন। স্বাধীনতা ঘোষণার প্রসঙ্গটি যদি সামনে আনি, তাহলে এক দল খুব দৃঢ়তার সঙ্গে তার পক্ষে কথা বলবে। তার বিপক্ষে বলারও লোক পাওয়া যাবে। তিনি রণাঙ্গনে সাহসিকতার সঙ্গে লড়েছেন। তার পরও কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী তো এই বাংলাদেশে আছেন। এদের কাজই হচ্ছে সবকিছুতে কোনো না কোনো মহলকে খুশি করার জন্য নিজের মনগড়া কথা তারা বলবেন। তাতে কি শহীদ জিয়াউর রহমানের সাহসিকতার অমর ইতিহাস পাল্টানো সম্ভব! আমার তো তা মনে হয় না।

২. বগুড়ার গাবতলীতে এই আলোচিত মহান নেতার জন্ম হয়েছিল। সেখানেই তার প্রাথমিক জীবনের শুরু। তারপর পিতার সঙ্গে কলকাতায় প্রাথমিক এবং কলেজ জীবনে লেখাপড়া। ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হলে তরতাজা তরুণ জিয়াউর রহমান পিতার হাত ধরে পাকিস্তানে চলে আসেন। আমরা যতটুকু জানি, তার পিতার কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানে হওয়ার কারণে তিনি সেখানে নতুন করে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। পরে কর্মজীবনের শুরুতে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে তরুণ ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমান বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে বাঙালির ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেন। রণাঙ্গন ছিল খেমকারান। এর পর জিয়াউর রহমান বীরউত্তমের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি তার জীবনে ঘটে যায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দিবাগত রাতে তার স্বাধীনতার ঘোষণা সারা বাংলায় বিদ্যুতের মতো ছড়িয়ে যায়। একজন মেজর ইতিহাসের মহান ব্যক্তি হিসেবে লাল কালিতে নিজের নাম লিপিবদ্ধ করেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে শুধু সেক্টর কমান্ডার নয়; রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের জেড ফোর্সের অধিনায়ক যুদ্ধ কাকে বলে তা দেখিয়ে দেন হানাদার বাহিনীকে। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর তিনি সেনাবাহিনীর উপপ্রধান হিসেবে সেনাবাহিনীর উন্নয়ন ও পুনর্গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি সেনাবাহিনীর সবচেয়ে জনপ্রিয় চৌকস ব্যক্তিত্ব হিসেবে সবার কাছে আদরের মানুষ ছিলেন।

৩. ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধের পর শহীদ জিয়াউর রহমানের জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ তাকে ইতিহাসের মহানায়কের স্বীকৃতি দিয়েছে। তৃতীয় ঘটনাটি হচ্ছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ। যে মানুষটি বাংলাদেশের জন্য রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন জীবন বাজি রেখে, তিনি যখন দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিচ্ছেন, তখন তো দায়িত্ব অনেক। সে দায়িত্ব তিনি প্রথম দিন থেকেই শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধ থেকে। এক দল থাকলে তো গণতন্ত্র হয় না। তাই সবকিছুর আগে তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন দান করেন। সব রাজনৈতিক দলকে মুক্ত করে দেন। সংবাদপত্র প্রকাশ করার অধিকার মুক্ত করে দেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের মূল ভবনের উদ্বোধন করেন তিনি। সংবাদমাধ্যমের দলন নীতির বিপরীত অবস্থান নিয়েছিলেন তিনি। শহীদ জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে থাকেন; তা দেখে মনে হয়, বাংলাদেশ নতুন করে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জীবনের মধ্যে ঢুকে গেল। ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদের দ্বিতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সেটিও একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ নির্বাচনে চারটি রাজনৈতিক দল জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামে একটি ফ্রন্ট গঠন করে। এই ফ্রন্টের প্রধান ছিলেন শহীদ জিয়াউর রহমান বীরউত্তম। এই ফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। এই জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট এক সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ; সংক্ষেপে বিএনপি।

৪. শহীদ জিয়াউর রহমান অর্থনৈতিক, সামাজিক, কৃষি, শিল্প, সংস্কৃৃতির যে সংস্কার করেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ হিসেবে চিহ্নিত। তিনি কিছু গণমুখী সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন, যা জনসাধারণকে আকৃষ্ট করেছিল। খাল খনন কর্মসূচি এর অন্যতম। ওই সময় তিনি দেড় হাজারের বেশি খাল খনন ও পুনর্খনন করেছিলেন। যার অর্থনৈতিক সুফল জনসাধারণ পেয়েছে। ১৯৭৭-৭৮ সালে খাদ্যশস্য রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদিত হয়। ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের পর জিয়াউর রহমানের সঠিক নেতৃত্বে প্রথম খাদ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। সে সময় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এ ছাড়া গণশিক্ষা কার্যক্রম, গ্রাম সরকার, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তিনি জনসাধারণকে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেন- রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদেরও শরিকানা রয়েছে। তৃণমূলকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন তিনি।

দেশের অর্থনীতির ভিত গড়ে দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি থেকে মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ সৃষ্টি করেছেন। তিনি প্রথম বিদেশে জনশক্তি রপ্তানি শুরু করেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ জিয়া সরকারের আমলেই নেওয়া হয়। সেই জনশক্তি আজ আমাদের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। যে পোশাকশিল্প ও রেমিট্যান্সের ওপর দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে, তার সূচনা হয়েছিল জিয়াউর রহমানের আমলেই। তিনি পোশাক রপ্তানির উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তরুণ উদ্যোক্তাদের ধরে ধরে এনে জামানত ছাড়া ব্যাংকের লোন দিয়ে গার্মেন্ট ব্যবসা শুরু করেন। সেই গার্মেন্ট এখন বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত।

জিয়াউর রহমান এ দেশে স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক প্রচলন করেছেন। পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি তার আমলেই শুরু হয়। তার সময়ে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রকৃতপক্ষেই জনসাধারণের জন্য সুফল এনেছিল। এখন দেশে বৃহৎ ওয়াটার রিজার্ভার বা পানি সংরক্ষণাগারের কথা বলা হয়। খাল খনন এই ওয়াটার রিজার্ভারেরই ৭০ দশকের রূপ। সেই সময়কে বলা হয় তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে স্বাবলম্বী একটি সময়ে দাঁড় করানো।

ড. ইউনূসকে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি শুরু করতে সহায়তা করেছিলেন জিয়া। আইসিডিডিআর,বি প্রতিষ্ঠিত হয় সে সময়ে। জিয়াউর রহমানের আমলে ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজির পরিবর্তে বেসরকারি প্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিকাশ ঘটে। ব্র্যাক, প্রশিকাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বড় পরিসরে কাজ শুরু করে। পল্লী বিদ্যুতায়ন তার সময়ের সৃষ্টি। এর মাধ্যমে তিনি ক্ষুদ্রশিল্পকে গ্রামীণ পর্যায়ে নিয়ে যান।

পররাষ্ট্রনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসেন শহীদ জিয়া। তার সুদক্ষ পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা চুক্তি ও সার্ক গঠন সম্ভব হয়েছিল। আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাবকে এককভাবে মোকাবিলা করে তিনি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারসাম্য আনতে চেয়েছিলেন। ওই সময়ের আঞ্চলিক রাজনীতিতে সার্কের উদ্যোগ নেওয়া সহজ ছিল না। আর ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে জাতিসংঘে অভিযোগ দাখিল করা ছিল অত্যন্ত সাহসিকতার বিষয়।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে দৃপ্ত পদে এগিয়ে যাওয়া শহীদ জিয়াউর রহমানের দিকে তাকালে মনে হয়- তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। তার সবকিছুই যেন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় মোড়ানো। বীরউত্তম যখন এই ধরাধাম থেকে কোনো ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ চলে যাচ্ছেন, তখন এই ঢাকা শহরে লাখো মানুষ কেন রাস্তায় নেমে তার জানাজায় যাওয়ার জন্য উদ্‌ভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছেন- কোথায় জিয়া, কোথায় জিয়া! ৪৫ বছরের জীবনে এতকিছু করা সম্ভব- তার জ্বলন্ত প্রমাণ শহীদ জিয়াউর রহমান বীরউত্তম।

ভাইস চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি

জিয়া লাইব্রেরী অনলাইন
Logo