জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : অমর বীরত্ব বিচ্ছুরিত আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য আত্নত্যাগের মহামহিমায় যেই ফোর্সটির যুদ্ধনামচায় কালের অমোচনীয় কালিতে লেখা রয়েছে কামালপুর বিওপি, বাহাদুরাবাদ ফেরিঘাট আর নকশী অভিযানের মতো বিখ্যাত সব যুদ্ধের রোমাঞ্চগাথা।
১৯৭১-এর রৌমারি মুক্তাঞ্চলের স্মৃতির দেরাজে যে ফোর্সটি ঘুমিয়ে আছে। চিলমারী, ছাতক, কোদালকাটি, বকশীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, টেংরাটিলা, বড়লেখার সময়তটে স্পষ্ট ছাপচিহ্ন রেখে গেছে যে বাহিনীটির স্বাধীনতা ক্ষুধার্ত যোদ্ধারা।
আসুন সেই যুদ্ধ নামচার পাতা ওল্টাই, স্মৃতির দেরাজ খুলে জাগিয়ে তুলি সেইসব ফেলে আসা দিনকে, জমে থাকা ধুলো সরিয়ে দেই যুদ্ধ ময়দানের সময়তটে।
১ম সপ্তাহ, জুন, ১৯৭১…
কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত হলো –
নিয়মিত পদাতিক একটি ব্রিগেড তৈরি করা হবে প্রতিরোধ যুদ্ধকে জোরদার করার জন্য। উদ্দেশ্য – হিট অ্যান্ড রান গেরিলা ট্যাকটিকসের বদলে সুসংহত নিয়মিত বাহিনীর মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সরাসরি যুদ্ধে মোকাবেলা করা। আর সে লক্ষ্যেই মেজর জিয়াউর রহমানের উপর ন্যস্ত করা হয় ব্রিগেডটির অধিনায়কত্ব।
জুন ১০ তারিখে বৃহত্তর চট্রগ্রামের ১নং সেক্টরের অধিনায়কত্ব ক্যাপ্টেন রফিকের হাতে দিয়ে জিয়া চলে আসেন বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের পাদদেশে ঘন গহিন জঙ্গল তেলঢালায়।
চারদিকে ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা – সাপ, বাঘ আর বুনো শুয়োরের আস্তনা শ্বাপদ সংকুল এই জঙ্গলটিতেই স্থাপিত হয়েছিলো জেড ফোর্সের হেডকোয়ার্টার।
জিয়ার সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ এবং ক্যাপ্টেন সাদেক।
জিয়া আগেভাগে চলে এলেও রেখে এসেছিলেন তাঁর ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক সৈনিককে।
কিছুদিনের মধ্যে মেজর এ জে এম আমিনুল হক চট্রগ্রামের রামগড় থেকে ৮ম বেঙ্গলের বাকি সব সৈন্যকে নিয়ে হাজির হন তেলঢালায়।
কাছাকাছি সময়ে ২৫ জুনের আগেই ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (বর্তমানে বিএনপির রাজনীতিবিদ) বনগাঁ থেকে ১ম বেঙ্গলকে নিয়ে যোগ দেন তেলঢালায়।
তবে তার আগে জুন ১৭ তারিখে মেজর শাফায়াত জামিল তাঁর ৩য় বেঙ্গলের ১১০০ সৈন্য নিয়ে তেলঢালায় জেড ফোর্স হেড কোয়ার্টারে যোগ দেন ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের রায়গঞ্জ জংশন থেকে।
১৩ই জুন কলকাতায় ৮নং থিয়েটার রোর্ডে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীর সাথে দেখা করেন মেজর মইনুল হোসেন এবং ওসমানীকে অভিমত জানান যে সরাসরি সেট পিস যুদ্ধে যাওয়ার মতো প্রশিক্ষিত যোদ্ধা এবং পর্যাপ্ত যুদ্ধ উপকরণ এখন বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলোর নেই। ওসমানি তাঁর সঙ্গে একমত হন নি এবং জেড ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন।
ওসমানীর নির্দেশ মোতাবেক মেজর মইন কলকাতা থেকে আসামের গুয়াহাটি হয়ে তেলঢালায় এসে যোগ দেন জেড ফোর্সে।
২০ জুন আনুষ্ঠানিক নিয়োগ সম্পন্ন হয় ব্রিগেড অধিনায়কত্বের।
ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান।
১ম, ৩য় এবং ৮ম ই বেঙ্গল – এই ৩টি রেজিমেন্টকে সমন্বিত করেই গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত প্রথম ব্রিগেড জেড ফোর্স।
২৫ জুনের মধ্যে জেড ফোর্স বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর ১ম পদাতিক ব্রিগেড হিসেবে সুসংগঠিত হয়।
৭ই জুলাই প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে ১ম নিয়মিত পদাতিক বেঙ্গল ব্রিগেডটিকে, সেপ্টেম্বরের শুরুতে যার নাম রাখা হয় ‘জেড ফোর্স’।
জুনের ২৫ তারিখ থেকেই শুরু হলো জেড ফোর্সের যুদ্ধ প্রশিক্ষণ।
জুলাই ২৮ তারিখ পর্যন্ত সেটি চলতে থাকে দুর্গম প্রতিকূল এক পরিবেশে যেমনটা জানা যায় ৩য় বেঙ্গল সিও মেজর শাফায়াত জামিলের কাছ থেকে:
২৮ জুলাই পর্যন্ত তেলঢালায় সর্বাত্নক যুদ্ধের ট্রেনিং চলতে থাকে। প্রায় সারাদিন ট্রেনিং চলে। রাতে প্রচন্ড মশার কামড় আর শুয়োর, সাপ ইত্যাদির উৎপাতে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল আমাদের। বাংলাদেশের ভেতরে ঢোকার জন্য মনে মনে সবাই অস্থির হয়ে উঠছিলাম…
এ প্রসঙ্গে ১ম বেঙ্গল সিও মেজর মইন যা বলেছেন:
আমরা ছিলাম এক গহিন জঙ্গলে যেখানে খাবার ও রসদ সরবরাহ ছিল অত্যন্ত দুরূহ। আমাদের অবস্থান থেকে সবচেয়ে নিকটবর্তী শহর ছিল তুরা – যার দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চল ছিল আমাদের খাদ্যক্রয়ের স্থান। অন্যান্য রসদপত্র ও সামগ্রী তুরা শহর থেকে সংগ্রহ করা হতো। এই অঞ্চলে ভারতীয় 101 Communication Zone কমান্ড করতেন মেজর জেনারেল গুলবত সিং গিল। সমস্ত বাধা বিপত্তির মধ্যেও গারো পাহাড়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আমরা প্রশিক্ষণ পূর্ণ উদ্যমে চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
প্রসঙ্গত জানাতে হয় – তেলঢালার দুর্গম পরিবেশে যে প্রতিকূলতা আর অসহনীয়তা মোকাবেলা করতে হয়েছে জেড ফোর্সকে তার কানাকড়িও সইতে হয় নি ত্রিপুরার মেলাঘরে অবস্থানরত খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্পটিকে।
এমনকি বেশির ভাগ সেক্টর কমান্ডারদের হেড কোয়ার্টার ছিল সীমান্তবর্তী শহরগুলোতে।
যাহোক, এবার যুদ্ধের ইতিহাসে ফিরি…
২৮শে জুলাই ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর জিয়া সিদ্ধান্ত নিলেন ৩টি বিপদজনক অপারেশনের যার প্রতিটি ছিল কৌশলগত দিক থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ন ৩টি পজিশনে। এ যুদ্ধগুলোর প্রতিটিতে ‘ডাই হার্ড স্ট্যামিনা’ আর ‘ডু অর ডাই’ আত্নপ্রতিজ্ঞার পরিচয় দিতে হয়েছিল জেড ফোর্স যোদ্ধাদের।
প্রথমটি ছিলো কামালপুর যুদ্ধ।
জুলাইয়ের ৩য় সপ্তাহে ১ম বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর মইনুল হোসেনকে জিয়াউর রহমান জানালেন কামালপুর বিওপি-তে হিট করতে হবে। মেজর মইন রাজি ছিলেন না। তাঁর মতে কামালপুরের মতো যথেষ্ট শক্তিশালী পাকিস্তানী ঘাঁটিতে সেট-পিস যুদ্ধের মাধ্যমে আক্রমণ করার সক্ষমতা জেড ফোর্সের নেই বা তার ব্যাটালিয়নের নেই। মেজর মইনের প্ল্যান ছিলো হিট অ্যান্ড রান গেরিলা পদ্ধতিতে পাকিস্তানি ফোর্সকে দুর্বল ও নাজেহাল করা।
কিন্তু জিয়া সিদ্ধান্ত পাল্টালেন না। এর মূল কারণ হাইকমান্ডের নির্দেশ এবং ঘাঁটিটির কৌশলগত গুরুত্ব।
মূলত জামালপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার সংযোগ সড়কটির উপর ছিল কামালপুর বিওপি। তাই ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হতে হলে কামালপুর বিওপি অবশ্যই দখল করতে হবে।
এটি এতই শক্তিশালী ঘাঁটি যে এই ঘাঁটিতে সর্বমোট ৪ বার নিয়মিত বাহিনী পর্যায়ে সরাসরি সেট-পিস যুদ্ধ হয়েছে – যথাক্রমে ৩১ জুলাই, ২২ অক্টোবর, ১৪ নভেম্বর, ২৪ নভেম্বর – ৪ ডিসেম্বর।
হিট অ্যান্ড রান হয়েছে মোট ২০ বার!
প্রথম গেরিলা হিট হয়েছিল ১২ জুন ।
এখানেই ১৪ নভেম্বরের যুদ্ধে মর্টার শেলের আঘাতে পা হারিয়েছেন মেজর তাহের বীরউত্তম।
পুরো মুক্তিযুদ্ধে কামালপুর অভিযানে সর্বমোট ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য, অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর আইয়ুব সহ ২২০ জন সেনা নিহত হয়েছেন।
বীরউত্তম থেকে বীরপ্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা সাহসিকতা পদক পেয়েছেন কেবল কামালপুর যুদ্ধের জন্যই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরণ আর একটিও নেই।