যেমন ছিলেন লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান

পিবিসি নিউজঃ  আজ জিয়াউর রহমানের জন্মদিন। স্বভাবতই আজ জিয়াউর রহমান নিয়ে আলোচনা হবে। জিয়াউর রহমানের কর্মকান্ড নিয়ে ব্যাপক কথাবার্তা আছে। তবে জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক চেতনা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না।

 

আমার যতদূর জানাশোনা তদানুসারে জিয়া ছিলেন ভাসানীর একজন খাস অনুসারী। তবে রাজনীতিতে ভাসানী যেমন ভুল করেছেন ইসলাম ইস্যুতে জিয়া সে ভুল করেননি বা করার সুযোগ হয়ে উঠেনি।

 

১৯৫৭ সালে ভাসানী পাকিস্তানকে ইসলামী রিপাবলিক করার প্রতিবাদে ও চীনের সাথে সম্পর্কিত হয়ে পররাষ্ট্রনীতি সাজানোর দাবীতে সোহরাওয়ার্দির সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। সে বিবাদের সূত্র ধরে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে ন্যশানাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠন করেন। এই ন্যাপ বাংলাদেশে চৈনিক বামদের সংগঠনে পরিণত হয়।

 

ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক, ভাসানীর শিষ্য মশিউর রহমান যাদু মিয়া লিখেছেন স্বাধীনতার আগে এক সেনা অফিসার মেজর কমল নামে ভাসানীর কাছে এসে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। তাঁর নির্দেশ মানতেন। এই মেজর কমলই হলেন লে. জেনারেল জিয়াউর রহমান।

 

বামরা যে স্বাধীন রাষ্ট্র চাইছে পাকিস্তান গঠনের পরপরই তার সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন ভাসানী। কারণ তাদের জানা ছিলো ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র পাকিস্তানকে বামাদর্শে পরিণত করা সহজ নয়। এজন্যই পাকিস্তান ভেঙে আলাদা রাষ্ট্রের দরকার ছিলো তাদের। কিন্তু ১৯৬৭ সালে বামদের মধ্যে তৈরি হওয়া আদর্শগত দ্বন্দ্ব ভাসানীকে দূর্বল করে দেয়।

 

ভাসানী ন্যাপ গঠনের পর মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগসহ অন্যান্যদের জোর প্রচারণায় তৎকালীন পাকিস্তানে ভাসানী একজন ইসলামবিরোধী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। যা তাকে অনেকটাই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে। এই সুযোগে ইসলামী আইনের কথা বলে বাঙালিদের কাছে জনপ্রিয় হয় মুজিব।

 

যাই হোক, যখন ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা হলো তখন ভাসানী বুঝেছিলো জনগণের সরকার ক্ষমতায় আসলে দাঙা তৈরি করা, অস্থিরতা তৈরি করা তথা স্বাধীনতার কথা বলা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই তিনি নির্বাচনকেই বয়কট করেছিলেন।

 

বাঙালিদের মধ্যে সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন ভাসানী। এই ইস্যুতে তার দলে ভাঙন তৈরি হয়। কিন্তু নির্বাচনের পর যখন স্বাধীনতার পরিস্থিতি তৈরি হয় তখন তিনি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে যান। কারণ ভারতের শত্রু হওয়ার সুবাদে পাকিস্তানের বন্ধু চীন পাকিস্তানের পক্ষে থাকে। চীন তাদের অনুসারী মাওবাদীদের পাকিস্তানের পক্ষে থাকার নির্দেশ দেয়।

 

ভাসানী, মশিউর রহমান এরা ভারতে চলে যান তবে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকেন। তবে ভাসানীরা অনুসারীরা যে যার মতো চলতে থাকে। মাওবাদীদের মধ্যে যারা সুশীল, বুদ্ধিজীবী তারা সবাই একযোগে বিনা সংকোচে পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেন। তাদের উল্লেখযোগ্যরা ১৪ ডিসেম্বর র’ ও মুজিব বাহিনীর হাতে খুন হন। যেমন মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লাহ কায়সার গং।

 

যারা বিপ্লবী ছিলো তাদের মধ্যে একটা অংশ যুদ্ধে এটেইন করে পাকিস্তানের বিপক্ষে, যেমন সিরাজ সিকদার। আবার অনেকে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে এটেইন করে যেমন কমরেড আব্দুল হক, কমরেড সত্যেন মিত্র, কমরেড বিমল বিশ্বাস, কমরেড জীবন মুখার্জী।

 

জিয়া ভাসানীর পরামর্শে বহুদিন ধরে স্বাধীনতার জন্য কাজ করেছেন। লোক তৈরি করেছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে মাওবাদী লোক তৈরি করেছেন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের দোহাই দিয়েও অনেককে ম্যানেজ করেছেন।

 

এদিকে রুশপন্থী বাম ও ভারতের যৌথ প্রযোজনায় পাকিস্তান ভাগের কাজ সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছিলো। ২৫ মার্চের জঙ্গীবিরোধী অভিযানে তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। শেখ মুজিবের কাছে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে যান ভারতীয় গোয়েন্দা কালিদাস বৈদ্য। তিনি তার ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্তরালের শেখ মুজিব’ এই প্রসঙ্গে আরো কথা বলেছেন। কিন্তু মুজিব কোনোভাবেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন সিদ্ধান্ত নিতে বা দিতে রাজি হন নাই। তিনি তাদের সব প্রস্তাব নাকচ করে স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হন। এতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা হতাশ হয়ে পড়ে।

 

জিয়া বামদের এতোদিনকার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ হতে দেননি। তিনি ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সমর্থনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিলেন। যা ষড়যন্ত্রকারীদের আবারো সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শুধু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নয় মূল ভূমিকায় পরিণত হয়।

 

এর পরের ইতিহাস তো জানেনই। পাকিস্তান ভাগ হয়ে গেলো। আবার যখন জিয়া ক্ষমতায় এলেন তখন তিনি মাওবাদীদের নিয়ে জাতীয়তাবাদ আদর্শ ধারণ করে দল তৈরি করেছেন। ওনার দীর্ঘ পথচলায় তিনি ইসলামকে ব্যবহার করতেন। ইসলামী ভাবাদর্শ লালনকারীদের হাতে রেখেছেন। তবে ধর্মীয় দল তথা ধর্মভিত্তিক দল তিনি পছন্দ করতেন না। একথা তিনি স্পষ্ট করেছেন।

 

চীনের সাথে ভাসানীর সম্পর্কের গভীরতা পাওয়া বুঝতে ১৯৭৩ সালের একটি ঘটনার দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। ১৯৭৩ সালের ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরোধীতা করে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটি ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসভা করে।সেই সভায় ভাসানী বলেছিলেন, ‘মুজিব, তুমি আমার সঙ্গে পিকিং বলো, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে গণচীনের স্বীকৃতি আদায় করবো। জিয়া ক্ষমতায় এসে ভাসানীর এই দাবী পূরণ করেছেন।

 

১৯৭৫ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের নানান বিপ্লব -প্রতিবিপ্লবের মধ্য দিয়ে নভেম্বরে জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। এই সময়ে ভাসানী জিয়াকে সাপোর্ট করেন। তমুদ্দুনের অধ্যাপক গফুর ভাসানীকে বলেন, ‘আপনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা। সেই আওয়ামী লীগ ছিল ক্ষমতায়। প্রকাশ্য জনসভায় আপনি আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের বলেছেন, দুর্নীতি করলে, জনগণের জন্য কাজ না করলে তোমাদের পিঠে চাবুক মারা হবে। আপনার নিজের দলের নেতাদেরও এমন কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছেন, আর আজ একজন সামরিক শাসককে আপনি সমর্থন দিচ্ছেন? জিয়ার প্রতি কেন আপনার এই দূর্বলতা?’

 

মওলানা বললেন : ‘আবদুল গফুর, আমি তোমার বাবার বয়সী। আমি আমার জীবনে তোমার চেয়ে বেশি সরকার ও বেশি নেতাদের দেখেছি। ব্রিটিশ আমলে দেখেছি, পাকিস্তান আমলে দেখেছি, বাংলাদেশ আমলেও দেখেছি। তুমি আমাকে একটা এক্সাম্পল দেখাও, কোন রাজনৈতিক নেতা কম-বেশি দূর্নীতি করে নাই বা দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় নাই এবং কোন নেতা স্বজনপ্রীতি করে নাই।’

 

যদিও ভাসানী জিয়ার সাথে আদর্শগত মিলের কথা স্বীকার করেননি তবে তিনি জিয়ার সব সিদ্ধান্তকেই সাপোর্ট করতেন এবং এর সমর্থনে বক্তব্য রাখতেন। ১৯৭৭ সালে জিয়া বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হন। জিয়ার ভালো দিকগুলোর অন্যতম হলো তিনি রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। যদিও তার সময়ের নির্বাচনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো তবে তিনি গণতন্ত্রের পরিবেশ তৈরি করেছেন। মুজিব যেখানে সবার রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে সেখানে তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনেছেন।

 

১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর তিনি বিএনপি গঠন করেন। তার দলের কর্মীদের বেশিরভাগ ছিলো ভাসানীর দল ন্যাপের। ভাসানী ততদিনে ইন্তেকাল করেছেন। তার আগে বছরের শুরুর দিকে জিয়াউর রহমানের পরোক্ষ উদ্যোগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট নামের রাজনৈতিক দল গঠিত হলে যাদু মিয়া ন্যাপ তথা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা-কর্মী নিয়ে এ দলে যোগ দেন। এই দলটি ই কিছুদিন পরে আরো কিছু দলের সাথে এক জোট হয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করে।

 

বিএনপি গঠন করার আগে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) নামে আরেকটি দল তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে সভাপতি করে গঠিত হয়েছিল। ২৮ আগস্ট ১৯৭৮ সালে নতুন দল গঠন করার লক্ষ্যে জাগদলের বর্ধিত সভায় ওই দলটি বিলুপ্ত ঘোষণার মাধ্যমে দলের এবং এর অঙ্গ সংগঠনের সকল সদস্য জিয়াউর রহমান ঘোষিত নতুন দলে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের প্রতিষ্ঠাতা তৎকালীন জিয়াউর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু করেন। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের আহ্বায়ক কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি প্রথমে ১৮ জন সদস্যের নাম এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ওই ১৮ জনসহ ৭৬ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেন। যাদু মিয়া এ দলের আহবায়ক কমিটির সদস্য ছিলেন।

 

এভাবেই চীনপন্থী বামেরা বিএনপিতে সংগঠিত হলেন। তবে জিয়া শুধু বামদের নয়। ডানপন্থী মুসলিম লীগেরও অনেক নেতাকে তার দলে স্থান দেন। ফলে বিএনপি একটি মধ্যমপন্থী দলে পরিণত হয়। ভাসানীর দলীয় প্রতীক ধানের শীষকেই জিয়া বিএনপির প্রতীকে আত্মীকরণ করেন।

 

রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর জিয়া বাংলাদেশের কূটনৈতিক নীতিমালায় বিশেষ পরিবর্তন আনেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তির দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে বিশেষ একটি কূটনৈতিক অবস্থানের সৃষ্টি হয়, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে প্রতিবেশী ভারতসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুতা অন্যান্য রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক নৈকট্য গড়ে তুলেছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আন্তর্জাতিক স্নায়ু যুদ্ধের তৎকালীন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখযোগ্য সংস্কার করেন যার দুটি মূল দিক ছিল সোভিয়েত ব্লক থেকে বাংলাদেশের সরে আসা ও মুসলিম বিশ্বের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক স্থাপন করা। জিয়াউর রহমান সোভিয়েত ইউনিয়ন ব্যতীত প্রাচ্যের আরেক পারমাণবিক শক্তি চীনের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে উদ্যোগী হন। ভাসানী অবশ্য সেই চিত্র দেখে যেতে পারেননি।

 

ভাসানীর ইচ্ছেপূরণে উদ্যোগী হলেও জিয়া ভাসানীর মাওবাদী আদর্শ যে পুরোপুরি গ্রহণ করেননি তা পরিষ্কারভাবে বলা যায়। তিনি এদেশের মানুষের আবেগের প্রতি লক্ষ্য রেখে ধর্মের পক্ষে কথা বলতেন। তাই এদেশের মানুষ তাকে ইসলামপ্রিয় হিসেবে জানে। তবে তিনি তার কর্মীদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় রাজনীতি সম্পর্কে বলেন, কোন রাজনৈতিক আদর্শ ধর্মকে ভিত্তি করে হতে পারে না। ধর্মের অবদান থাকতে পারে রাজনীতিতে, কিন্তু রাজনৈতিক দল ধর্মকে কেন্দ্র করে হতে পারে না। এটা মনে রাখবেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

জিয়া লাইব্রেরী অনলাইন
Logo