উৎপাদনের রাজনীতি ও জিয়াউর রহমান

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে শাসনকার্য পরিচালনায় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিল। পরে সেনাবাহিনীর একাংশের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। এতে সপরিবারে শেখ মুজিব নিহত হন। ৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এর এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়া বন্দি হন। কিন্তু ৭ নভেম্বর সাধারণ সেনাসদস্যরা তাকে মুক্ত করেন। এরপর জিয়া ক্ষমতাকে আরো সুসংহত করেছিলেন। এ সময় জিয়া উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ লাভ করেন। পরবর্তীকালে এক ঘোষণার মাধ্যমে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। জিয়াবিরোধী কয়েকটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান সত্ত্বেও সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। এতে জনগণের মধ্যে তার একটি ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। ১৯৭৬-এর জুলাই মাসে দেশ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিকাশের এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করে। এক বছর বিরতির পর সামরিক সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের কর্মতৎপরতা ফের শুরু করার অনুমতি দেয়া হয়। রাষ্ট্রপতি সায়েম কর্তৃক ঘোষিত রাজনৈতিক দল বিধির অধীনে দলগুলোকে দেশের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনাসহ দলের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, কর্তব্য এবং বাস্তব সম্ভাবনা সুস্পষ্টভাবে সরকারের সামনে উপস্থাপনের নির্দেশ দেয়া হয়।

১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন এবং ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতি হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণ এবং অর্থনীতি পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতি জিয়ার বিভিন্ন পদক্ষেপ দেশ ও বিদেশে প্রশংসিত হয়।

 

জিয়াউর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন, রাজনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কার অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। তিনি সব সময় ভাবতেন, কিভাবে নিজস্ব আঙ্গিকে জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলা যায়।

তিনি ছিলেন একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সৈনিক নেতা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক সংস্কারক ও সর্বোপরি রাষ্ট্রনায়কোচিত ব্যক্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকে তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করেছিলেন। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে যে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলেন, তার আলোকেই দ্বিবার্ষিক অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রণীত হয়েছিল। এর উল্লেখ পাওয়া যায় ১৯৭৮ সাল থেকে কার্যকর হওয়া পরিকল্পনা কমিশনের দলিলে। বিএনপি গঠনের পর ১৯ দফাকে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৯ দফা কর্মসূচি এখানে তুলে ধরা হলো :

 

১. সর্বতোভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখ-তা ও সার্বভৌমত্ব। ২. সংবিধানের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক আস্থা ও বিশ্বাস, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলিত করা। ৩. সর্ব উপায়ে নিজেদের আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে গড়ে তোলা। ৪. প্রশাসনের সর্বস্তরে উন্নয়ন কার্যক্রমে ও আইনশৃক্সক্ষলা রক্ষার ব্যাপারে জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ৫. সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা। ৬. দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেউ যেন ভুখা না থাকে তার ব্যবস্থা করা। ৭. কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সবার জন্য অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা। ৮. কোনো নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে তার ব্যবস্থা করা। ৯. দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা। ১০. সব দেশবাসীর জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। ১১. সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং যুবসমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা। ১২. অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান। ১৩. শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা। ১৪. সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তি উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন। ১৫. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ। ১৬. সব বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বিশেষ জোরদার করা। ১৭. প্রশাসন ও উন্নয়নব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। ১৮. দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়নীতিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। ১৯. ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সব নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করা।

 

 

১৯ দফা কর্মসূচির মূল উদ্দেশ্য ছিল : উন্নয়নের হার বাড়ানো, উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির লক্ষ্যে পরনির্ভরশীলতা কমানো, আয়ের সুষম বণ্টন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এ জন্য দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রফতানি আয় বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জন। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গ্রামের জনগণকে সম্পৃক্ত করে গ্রামীণ জীবনযাত্রার মান উন্নত করা ছিল পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য। বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের অগ্রণী ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এ ছাড়া ব্যাপক খাল খনন কর্মসূচি, স্বনির্ভর প্রকল্প এবং বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিরও তিনি ছিলেন প্রধান প্রবক্তা।

 

 

গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন : জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারার উৎস ছিল গ্রামবাংলা। এ চিন্তাধারা থেকেই তিনি উন্নয়ন কর্মকা-ের সূচনা করেন। তার পদক্ষেপই গ্রামসরকার, ভিডিপি, যুব কো-অপারেটিভ কমপ্লেক্স নামক গ্রামকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম শুরু করে। পল্লী উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। ফলে গ্রামকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে সূচিত হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

 

 

বিশেষ ঋণ বিতরণ কর্মসূচি : পল্লীর সাধারণ মানুষের অবস্থার পরিবর্তনের জন্য জিয়ার আগ্রহে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের ব্যয়ভার নির্বাহের জন্য কৃষকদের মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ১০০ কোটি টাকার বিশেষ ঋণ বিতরণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। একজন কৃষক নির্ধারিত ঋণ পরিশোধ করে বছরে তিনটি ফসলের জন্য ঋণ নিতে পারতেন। এই কর্মসূচির বৈশিষ্ট্য ছিল, ঋণ নেয়ার জন্য জমি ব্যাংকে দেয়ার প্রয়োজন হতো না এবং বর্গাচাষিসহ জমির মালিক চাষিও এ ঋণ নিতে পারতেন।

 

 

স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি : ভিক্ষুকের হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে একটি জাতীয় আন্দোলন হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচির সূচনা।

 

 

খাল খনন কর্মসূচি : জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা কর্মসূচি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির ক্ষেত্রে এক শান্তিপূর্ণ বিপ্লব হিসেবে দেশ ও বিদেশে অভিহিত হয়েছিল। এর আওতায় তিনি খাল খনন কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা, সেচের পানির স্বল্পতা, পানিসম্পদ সংরক্ষণ এবং উপযুক্ত ব্যবহারের অভাব ইত্যাদি দৃষ্টিকোণ থেকে খাল খনন কর্মসূচি ছিল অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ। ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে জিয়াউর রহমান সারা দেশে এ কর্মসূচির সূচনা করেন।

 

গ্রামসরকার প্রতিষ্ঠা : গ্রামসরকার শহীদ জিয়ার গ্রামকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ। ১৯৭৬ সালে গ্রাম পরিষদ গঠন করা হলেও তা পার্লামেন্টারি অ্যাক্ট ৯-১এর আওতায় ১৯৮০ সালে গ্রামসরকার হিসেবে কাজ শুরু করে। দেশের সার্বিক উন্নয়নে জিয়া গ্রামকে মৌলিক ইউনিট হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রামসরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

 

 

শহীদ জিয়াউর রহমানের গ্রামকেন্দ্রিক এ ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচিকে বিশ্লেষকরা ‘উৎপাদনের রাজনীতি’ হিসেবে অভিহিত করে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে তা ব্যাপক অবদান রেখেছিল বলে জিয়ার প্রশংসা করেছিলেন।

 

 

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জনকল্যাণমূলক অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ফলে দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং শান্তিশৃক্সক্ষলা ফিরে আসে। এ জন্য দেশ ও বিদেশে তার শাসনামল যথেষ্ট প্রশংসিত হয়।

 

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

যে আদর্শের বিকল্প নেই

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ

রাজনীতি বিজ্ঞানে ‘জাতীয়তাবাদ তত্ত্বের’ মধ্যে দুটি তত্ত্ব সাম্প্রতিককালে বহুলভাবে আলোচিত। এর একটিতে বলা হয়েছে, ÔThe nation creates the stateÕ এবং অন্যটিতে বলা হয়েছে, ÔThe state creates the nationÕ অর্থাৎ জাতিরাষ্ট্র গঠনের কারক, অন্যপক্ষে রাষ্ট্র জাতি গঠনের কারক। প্রথম প্রপঞ্চটি ইউরোপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য আর দ্বিতীয়টি উপনিভেশ-উত্তর এশিয়া ও আফ্রিকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ইউরোপে জাতি গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মানচিত্রের উদ্ভব রাষ্ট্র ও জাতি উভয়কেই দিয়েছে একটি টেকসই চরিত্র। এশিয়া ও আফ্রিকার ক্ষেত্রে উপনিভেশবাদ থেকে মুক্ত হয়ে যেসব রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে, সেগুলো অবশ্যম্ভাবীরূপে জাতিতে রূপান্তরিত হতে পারেনি কিংবা এই রূপান্তরের পথে দুরতিক্রম্য বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছে।

 

 

মানব সন্তানদের একটি অংশকে জাতি হিসেবে তখনই গণ্য করা যায় যখন তারা নিজেদের মধ্যে স্বেচ্ছামূলক অনুভূতির বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হয়। এই সমানুভূতি মানবগোষ্ঠীর এই নির্দিষ্ট অংশ অন্য কারোর সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে অনুভব করতে চায় না। এই সমানুভূতির ফলে তারা একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা করে, যা তারা অন্য লোকের সঙ্গে করে না। তারা সবাই একসঙ্গে বাস করতে চায় এবং কামনা করে যে, সরকার তাদের দ্বারা অথবা তাদের মধ্য থেকে নেয়া ব্যক্তিবর্গকে দিয়ে গঠিত হবে। জাতি গঠনের জন্য এই ধরনের সমানুভূতি অপরিহার্য।

১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে জওহরলাল নেহরু একজন বিরোধী রাজনীতিক থেকে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রচ- অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়েছিলেন। ক্ষমতা লাভের পর তাকে যেন একটি নীতি কার্যকর করতে হয়েছিল, যা তিনি তার কংগ্রেস রাজনীতির মধ্য দিয়ে প্রচার করেছেন। অথচ কখনো পছন্দ করেননি। প্যাটেল ও সীতারামাইয়ার সঙ্গে তিনিও ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন কমিটির সদস্য হয়েছিলেন। প্রায় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কংগ্রেস ভারতে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠনের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল এবং ব্রিটিশ শাসকদের ভাষাভিত্তিক বিবর্জিত স্বৈরাচারী প্রশাসনিক ইউনিট গঠনের বিরোধিতা করে আসছিল। যুক্তি ছিল, ভাষার ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন না করে ব্রিটিশরা সা¤্রাজ্যবাদী ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি অনুসরণ করেছে। ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন কমিটিতে কাজ করতে গিয়ে নেহরু তার তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন : (This inquiry) has been in some ways an eye-opener for us, the work of 60 years of The Indian National Congress was standing before us, face to face with centuries-old India of narrow loyalties, petty jealousies and ignorant prejudices engaged in mortal conflict and we were simply horrified to see how thin was the ice upon which we were skating. Some of the ablest men in the country came before us and confidently and emphatically stated that language in this country stood for and represented culture, race, history, individuality and finally a sub-nation.

 

 

আতঙ্কিত বোধ করে থাকুন বা নাই থাকুন, নেহরু, প্যাটেল এবং সীতারামাইয়া অবশেষে অন্ধ্রকে তেলেগু ভাষী রাজ্য হিসেবে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হলেন। যে হালকা বরফের আস্তরণের ওপর নেহরু স্কেটিং খেলার কথা বলেছেন, তা ভেঙে গেল। এক দশকের মধ্যে সমগ্র ভারতীয় প্রশাসনকে ভাষার ভিত্তিতে পুনর্গঠন করা হলো। দেশ-বিদেশের প-িত ও চিন্তাবিদরা ভাবতে শুরু করলেন, যেভাবে সঙ্কীর্ণ আনুগত্য, ক্ষুদ্র হিংসা-বিদ্বেষ ও মূর্খ সংস্কারকে প্রশ্রয় দেয়া হলো তাতে করে ভারত এক রাষ্ট্র হিসেবে কত দিন টিকে থাকবে। নবগঠিত ভারত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নেহরু যেই সমস্যা ভাষার মধ্যে দেখেছিলেন, এশিয়া-আফ্রিকায় নবগঠিত রাষ্ট্রগুলোর ক্ষেত্রে সে সমস্যা দ্বি-বাচনিক অথবা বহুবাচনিক অথবা বহুতর বাচনিক সমাজের সমস্যা হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। কখনো বলা হয়েছে, এই সমস্যা যৌগিক সমাজ অথবা নিম্ন সমাজের সমস্যা। কখনো বলা হয়েছে, এগুলো রাষ্ট্র, কিন্তু জাতি নয়। আবার কখনো বলা হয়েছে, এগুলো জাতি বটে, রাষ্ট্র হতে পারেনি। আবার কখনো বা গোত্রবাদ, সঙ্কীর্ণতাবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ অথবা অধিজাতীয়তাবাদের সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ভারতের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বৈপরীত্য, মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে জাতিগত বৈপরীত্য এবং কঙ্গোর ক্ষেত্রে গোত্রগত বৈপরীত্য নির্দেশ করে।

 

 

ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হলো, আঞ্চলিক অসন্তোষ আর মরক্কোর ক্ষেত্রে সমস্যা হলো সামাজিক প্রথা-আচরণে পার্থক্য। শ্রীলঙ্কায় সংখ্যালঘু তামিলরা সংখ্যাগুরু সিংহলিদের থেকে ভাষা, জাতিগত বৈশিষ্ট্য, আঞ্চলিক অবস্থান এবং সামাজিক প্রথার বিচারে পৃথক। ইরাকের ক্ষেত্রে একই ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে রয়েছে বিরোধ। এভাবে কুর্দিস্তান, লাওস, বার্মা ও থাইল্যান্ডে জাতি, গোত্র এবং ভাষাগত বিরোধ রয়েছে। সম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য শেষ বিচারে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যে পরিণত নাও হতে পারে। রাষ্ট্র যখন সম্প্রদায়গুলোকে একটি চূড়ান্ত সম্প্রদায়ে রূপ দিতে সক্ষম হয়, তখনই একটি রাষ্ট্র জাতির বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। এ ক্ষেত্রে জাতির কথা না বলে চূড়ান্ত আনুগত্যের কথা বলাই শ্রেয়। ইমারসনের দৃষ্টিতে জাতি হলো : ÔTerminal community the largest community that, when the chips are down, effectively commands men’s loyalty, overriding the claims both of the lesser communities within it and those that cut across it or potentially enfold it within a still greater society…’

 

ইমারসনের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, অনাগত দিনের সঙ্কটে ভারত, ইন্দোনেশিয়া অথবা নাইজেরিয়া জাতি হিসেবে উত্তরণে সক্ষম হবে কি না। ১৯৭১-এ একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। ভাষা, ধর্ম, ভূগোল, সংস্কৃতি ও লোকাচারের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ একটি সমধর্মী রাষ্ট্র। এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ অবধি একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে কিনা তা প্রশ্নাতীত নয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবলগ্নে যে পার্থক্য এই রাষ্ট্রকে জাতি হিসেবে সুসংহত হতে বাধা সৃষ্টি করে, তা মুলত আদর্শিক। আমাদের জাতি গঠনের সমস্যা ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া অথবা মালয়েশিয়ার অনুরুপ নয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে এসব দেশে ভাষাগত, জাতিগত, কৃষ্টিগত অথবা অঞ্চলগত বিরোধ জাতি গঠনের অন্তরায়; কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এসব সমস্যা না থাকা সত্ত্বেও জাতি গঠন কেন পরিপুর্ণভাবে সম্ভব হলো না-সেই প্রশ্ন স্ববিরোধী মনে হতে পারে। আসলে কি তাই? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জনগোষ্ঠীর মধ্যকার দ্বন্দ্বটি একান্তই আদর্শিক। ’৭১-এ যখন মুক্তিযুদ্ধ হয় তখন এ দেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশ (ক্ষুদ্র অংশ হলেও) পাকিস্তান বিশ্বাস করত। সেই অংশটি অবিভক্ত ব্রিটিশ-ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর বঞ্চনার কথা ভুলতে পারেনি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর যে দলটি ক্ষমতাসীন হয়েছিল তাদের দায়িত্ব ছিল জাতি গঠনের স্বার্থে এই আদর্শিক দ্বন্দ্বের রাজনীতিসম্মত সুরাহা করা। বাংলাদেশকে একান্তভাবেই ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে এই দলটি আত্মবিরোধের জন্ম দিল। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, ১৯৪৭-এর ১৪ আগষ্ট যে ভুখন্ড নিয়ে তৎকালীন পুর্ব পাকিস্তান গঠিত হয়েছিল তাই হবে বাংলাদেশ। অথচ র‌্যাটক্লিফের রোয়েদাদে পুর্ব পাকিস্তানের যে মানচিত্র, সে মানচিত্রের ভিত্তি ছিল এ দেশেরই সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্ম। পশ্চিমবঙ্গের লোকেরাও বাংলা ভাষায় কথা বলে, কিন্তু তারা এবং তাদের নেতারা ১৯৪৭-এ ভাষার ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সঙ্গে মিলিত হয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চাননি। ইমারসন যে আনুগত্যের কথা বলেছেন, সেই আনুগত্যের বিচারে তারা দিল্লিকেন্দ্রিক ভারত রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত। নিজেদের সত্তার পরিচয় দিতে গিয়ে তারা বলে থাকেন, তারা হলেন ভারতীয় এবং ভারতীয় বাঙালি। সুতরাং এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং এর জাতিগত পরিচয় শুধু ভাষাভিত্তিক হতে পারে না। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অধীনে একটি সুসংহত জাতি গঠন করতে হলে ভাষা ও ধর্ম-এর দুটোকেই গুরুত্ব দিতে হয়। আমাদের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই দুটোরই আবেগানুভুতি প্রবল। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পর যে সংবিধান গৃহীত হয়, তাতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকে’ রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করায় এ দেশের জনগোষ্ঠীর বিপুল অংশের ধর্মানুভূতি আহত হয়। অথচ জাতীয় সংহতির স্বার্থে প্রয়োজন ছিল এ রকম আহত অনুভূতির উদ্ভব না ঘটানো।

 

বাংলাদেশের অভ্যুদয়কালীন এবং অভ্যুদয়ের অব্যবহতি পর যে দলটি ক্ষমতায় গিয়েছিল তারা জাতীয় ঐক্যের কথা চিন্তা না করে জাতীয় জীবনে একটি আদর্শিক ফাটল সৃষ্টি করে। এই ফাটল আরো প্রবল আকার ধারণ করে স্বাধীনতার স্বপক্ষ ও বিপক্ষ শক্তির বিভেদাত্মক স্লোগানের ফলে। অথচ নবীন রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল জাতীয় ঐক্যের। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সবার ধর্মানুভূতিকে স্বীকার করে নেয়া এবং যুদ্ধকালীন বিরোধের ইতি ঘটিয়ে একটি সহমত সৃষ্টি করাই ছিল জাতীয় ঐক্য অর্জনের প্রশস্ত পথ; কিন্তু সেই পথে তো এই দলটি গেলই না, বরঞ্চ ১৯৭৫-এ বহুদলীয় গণতন্ত্রের কবর রচনা করে একদলীয় শাসন কায়েম করে বিভিন্ন বিরোধী মত ও আদর্শের নিরাপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হওয়ার যে সুযোগ ছিল, তারও কবর রচনা করা হলো। এর ফলে আদর্শিক দ্বন্দ্বের উত্তাপ প্রশমিত হওয়ার আর কোনো সুযোগই রইল না। অন্যদিকে ’৭২-এ সংবিধান প্রণেতারা মারাত্মক একটি স্ববিরোধিতার জন্ম দিয়েছিলেন। কারণ এই সংবিধানে বাংলাদেশের সব নাগরিকের ভোটাধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল, অথচ নিজ নিজ আদর্শের ভিত্তিতে সব ধরনের দল গঠনের নিশ্চয়তা ছিল না। ধর্মীয় দলগুলো ছিল নিষিদ্ধ। এসব কারণে বাংলাদেশের অন্তর্গত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহুমাত্রিক সমধর্মিতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ রাষ্ট্র জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হলো না।

 

১৯৭৫-এর ৭ নভেম্বর ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান এ দেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে পরিবৃত হলেন। একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমানের বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অবদান ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’, যা এই রাষ্ট্রের অন্তর্গত সব মানুষকে সত্তার পরিচয় আবিষ্কারে একটি আদর্শগত ভিত্তি দিয়েছে। এই ভিত্তি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান আদর্শিক দ্বন্দ্ব নিরসনে সুদুরপ্রসারী অবদান রাখতে সক্ষম হবে। জিয়াউর রহমান লিখেছেন, ‘এই পর্যায়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মুল বিষয়গুলো ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে, যা ছাড়া জাতীয়তাবাদী দর্শনের আন্দোলন এবং তার মূল লক্ষ্য, অর্থাৎ শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ হয়ে পড়বে অসম্পুর্ণ, ত্রুটিপূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর। আমরা বলতে পারি, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে মোটামুটি সাতটি মৌলিক বিবেচ্য বিষয় রয়েছে, যা হচ্ছে:

 

 

১. বাংলাদেশের ভূমি; অর্থাৎ আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যবর্তী আমাদের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক এলাকা, ২, ধর্ম ও গোত্র নির্বিশেষে দেশের জনগণ, ৩. আমাদের ভাষা বাংলা ভাষা, ৪. আমাদের সংস্কৃতি জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা, উদ্দীপনা ও আন্তরিকতার ধারক ও বাহক আমাদের নিজস্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি, ৫. ২০০ বছর উপনিভেশ থাকার প্রেক্ষাপটে বিশেষ অর্থনৈতিক বিবেচনার বৈপ্লবিক দিক, ৬. আমাদের ধর্ম প্রতিটি নারী ও পুরুষের অবাধে তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় অনুশাসন ও রীতিনীতি পালনের পুর্ণ স্বাধীনতা, ৭. সর্বোপরি, আমাদের ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যার মধ্য দিয়ে আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন বাস্তব ও চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে।

 

 

 

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের যে সাতটি ভিত্তির কথা বলেছেন, সেই ৭টি নীতির সফল রূপায়ণই বাংলাদেশের অন্তর্গত জনগোষ্ঠীকে সমানুভূতির মানুষে পরিণত করতে পারে। একে রূপান্তরিত করতে পারে সর্বোচ্চ সম্প্রদায়গত সংহতিতে এবং সংকটে একাট্টা হতে।

 

 

এতেই কেবল বাংলাদেশ রাষ্ট্র থেকে জাতিতে উত্তরণে সক্ষম হবে। জিয়াউর রহমানের আরেকটি বড় অবদান-বহুদলীয় গণতন্ত্র। এই বহুদলীয় গণতন্ত্র ’৭২-এর সংবিধানে নির্দেশিত খ-িত বহুদলীয় গণতন্ত্র নয়। জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের সুবাদে সব মত ও পথের মানুষ রাষ্ট্রক্ষমতার অঙ্গনে নিরাপদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ পেয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের এই ধারা বাংলাদেশে জাতীয় সংহতি অর্জনের পথকে সুগম করে দিয়েছে। আজ জিয়াউর রহমান নেই, রয়েছে তার কালজয়ী আদর্শ বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। আগামী দিনে বাংলাদেশী জাতি রাষ্ট্র গঠনের জন্য এই আদর্শের কোনো বিকল্প নেই। আজ বাংলাদেশে যে বিপর্যস্ত সময় চলছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদই হতে পারে একমাত্র আদর্শিক ভিত্তি।

ড. মো. শামছুল আলম

জিয়া লাইব্রেরী অনলাইন
Logo