যেকারনে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা জিয়াউর রহমানকে প্রাণ দিতে হয়েছিল

জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এটা কারও পছন্দ-অপছন্দের বিষয় নয়। যারা নিয়তিতে বিশ্বাস করেন তারা বলবেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিয়তি তাকে এই আসনে বসিয়েছে। নিয়তির কারণে তিনি পরিণত হয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূর্ত প্রতীকে। যারা আজকে তার সেই ভূমিকা নিয়ে কূটতর্ক চালাচালি করেন, তারাও বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন না—‘আমি মেজর জিয়া বলছি’ এই ঘোষণাটি তাদের উদ্দীপ্ত করেনি। পঁচিশে মার্চে নেমে আসা অন্ধকারে আলো জ্বেলে দিয়েছিল জিয়ার এই ঘোষণা।

নিয়তিতে বিশ্বাস করলে পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য উদাহরণ মিলবে। এটা ঠিক, নিয়তিকে সব সময় যুক্তি-তর্ক দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। কিন্তু নিয়তি কখনোই ইচ্ছা বা মানসিক শক্তির বাইরে কাউকে কোনো আসন দেয় না। যারা নিয়তিতে বিশ্বাস করেন না, তারা বিষয়টিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবেন। বলবেন, তর্কের খাতিরে যদি ’৭১ সালের ঘটনাকে নিয়তির আশীর্বাদ হিসেবে বর্ণনা করা হয়, তাহলে পরবর্তী পর্যায়ে বাংলাদেশকে বদলে দেয়ার জন্য জিয়ার ভূমিকাকে কীভাবে বিশ্লেষণ করা হবে?
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একাংশের হাতে ঊনত্রিশ বছর আগে কেন প্রেসিডেন্ট জিয়া নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন? আজ এ প্রশ্নের জবাব অত্যন্ত জরুরি। ১৯৭৫ সালে সিপাহি-জনতার ষড়যন্ত্রবিনাশী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় অভিষিক্ত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তার চিন্তার জগতে শুধু সেনাবাহিনী বা চাকরি নয়—দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিসহ সবকিছু অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। চিন্তার জগতের এই প্রসারতার প্রতিফলন ঘটে তার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে।

জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছিলেন তারই প্রিয় সহকর্মী ও অনুগতদের হাতে। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। অতীতের ঘটনাবলির পর্যালোচনায় দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর প্রথমটি হচ্ছে ষড়যন্ত্র, অপরটি হচ্ছে সেনানায়ক থেকে তার জননায়কে উত্তরণ। ষড়যন্ত্র তত্ত্বটিকে বহুল আলোচিত মনে হলেও এটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাস্তবচিত্রের প্রতিফলন। এক্ষেত্রে কথাটিকে ষড়যন্ত্র না বলে একটি রাষ্ট্রের বিরাগভাজন হওয়াকেও উল্লেখ করা যেতে পারে। জিয়াউর রহমানের একটি বড় অন্যায় ছিল তিনি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন, একটি রাষ্ট্র যদি তার ইচ্ছা অনুযায়ী পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে, তাহলে সে রাষ্ট্রটি সার্বভৌমত্বের মর্যাদা অর্জন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেসব রাষ্ট্রনায়ক এই নীতি অনুসরণ করেছেন, তাদের অধিকাংশকেই নির্মম পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য নাম ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, শ্রীলঙ্কার বন্দরনায়েক, পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ইরাকের সাদ্দাম হোসেন। এরকম আরও অসংখ্য উদাহরণ আছে। এই একই অপরাধে সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হয়েছিলেন চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দে এবং বর্তমানে হুমকির মুখে আছেন ভেনিজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ।

জিয়াউর রহমান কি ভারত ও আমেরিকাবিদ্বেষী ছিলেন? বিষয়টিকে এত সরলীকরণ করা সম্ভব নয়। উভয় ক্ষেত্রে তিনি চেয়েছিলেন জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন না দিয়ে জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নির্মাণ করতে। আবার এটাও সত্যি, জিয়াউর রহমানের অনেক সিদ্ধান্তই প্রতিবেশী ভারতসহ অনেকের উষ্মার কারণ হয়েছিল। এই অঞ্চলে ভারত যেহেতু আঞ্চলিক প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়, তাই তার আকাঙ্ক্ষা এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো তাকে গুরু বলে মেনে নেবে। এর পাশাপাশি ভারত তার জাতীয় স্বার্থকেও অনেক বড় করে দেখে। এ কারণেই মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী এখন আর ভারতের মাথাব্যথার কারণ নয়। ভারত এখন মিয়ানমারের সেনাশাসকদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক বেশি তত্পর। জিয়াউর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির স্বাধীন পথচলার কারণে বাংলাদেশ জগত্সভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

এর পর আসে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তার অনুসৃত নীতির প্রসঙ্গ। প্রথমে যে বিষয়টি আলোচনা করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে তার জননির্ভর রাজনীতি। সামরিক শাসন দীর্ঘায়িত না করে তিনি গণরাজনীতিকে উদ্ধার করেন ১৯৭৫-পূর্ব সময়ে পতিত পঙ্কিল আবর্ত থেকে। একই সঙ্গে তিনি নিজেও বেরিয়ে আসেন সেনা প্রভাব থেকে এবং রাজনীতিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন ব্যক্তির কাছে। জিয়াউর রহমানের আগে ব্যক্তি আসত রাজনীতির কাছে। কিন্তু তিনি রাজনীতিকে নিয়ে যান ব্যক্তির কাছে। যেটা রাজনীতিবিদ ও সেনা কর্মকর্তাসহ অনেকের মনোকষ্টের কারণ হয়েছে। এ কারণেই তার খণ্ডিত উদ্ধৃতি ব্যবহার করে তাকে ভিলেন বানানোর চেষ্টা করেন ওইসব ব্যক্তি, যারা বিভিন্ন কলাকৌশলে জনগণের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চান। বাংলাদেশের সব রাজনীতিবিদের মধ্যে জিয়াউর রহমানই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি দেশের লাখো লাখো মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন, তাদের দুয়ারে গিয়েছেন, দিন ও রাতে তাদের সুখ-দুঃখের কাহিনী শুনেছেন এবং পরামর্শ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। জনরাজনীতির যে ধারার সূত্রপাত ঘটে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই ধারার অবসান ঘটে। জনগণের কাছে পৌঁছতে পেরে জিয়াউর রহমান অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত যেটা আর কেউ স্থাপন করতে পারেননি। এই জনরাজনীতির উন্মেষই জিয়াউর রহমানের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আমলা ও সেনাবাহিনীসহ সমাজের বিভিন্ন সুবিধাভোগী গোষ্ঠী, যারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাদের কাছে জনরাজনীতির বিকাশ হুমকির মত। জিয়াউর রহমান মোহিনী ব্যক্তিত্ব দিয়ে জনগণের মনোজগতকে বদলে দিয়েছিলেন। অবশ্য স্বাধীনতা যুদ্ধে তার ভূমিকা এক্ষেত্রে প্রভাবকের কাজ করেছে। বাংলাদেশের জনগণের কাছে জিয়াউর রহমানকে পরিচিত করাতে হয়নি। নিয়তির বরপুত্র অথবা কর্মের সফল পুরুষ যাই হোক না কেন, তা জিয়াউর রহমানকে যে আসনে বসিয়েছে তা অনেকেরই উষ্মার কারণ। তারা এখনও জিয়াউর রহমানকে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি মনে করেন এবং এ কারণে লাখ লাখ মানুষের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের পর সমাহিত এই মানুষটিকে নিয়ে মাথাব্যথার অন্ত নেই। তাই এখনও তার চরিত্র হননের প্রচেষ্টা একটি মহলে বিশেষভাবে সক্রিয়।

জিয়াউর রহমানের আরেকটি বড় অবদান আধুনিক বাংলাদেশ নির্মাণের পথ চলার সূত্রপাত। জিয়াউর রহমান তার সব কর্মকাণ্ড দিয়ে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছিলেন, যার অসংখ্য উদাহরণ এখনও টিকে আছে। এই আধুনিকীকরণের প্রয়াসও জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হতে অন্ধকারের শক্তিকে উত্সাহিত করেছিল। জিয়াউর রহমান বেঁচে আছেন তার কর্মের মাধ্যমে। যদিও সেসব কর্মের বহু প্রতীককে মুছে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু সে উদ্যোগ জনসমর্থন লাভ করেনি। ঘোষণা দিয়ে অথবা পরিপত্র জারি করে জনমন থেকে তাদের প্রিয় নেতার নাম মুছে ফেলা যায় না। এ কারণেই ইংরেজ শাসক ও তার দোসরদের শত-সহস্র চেষ্টার পরও সিরাজ-উদ-দৌলাকে কলঙ্কিত করা যায়নি। জীবনের সীমাবদ্ধতা এবং ভুলভ্রান্তি কাটিয়ে সিরাজ-উদ-দৌলা হয়ে উঠেছেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব।

জিয়া লাইব্রেরী অনলাইন
Logo