অমর-অম্লান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান

জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : মানুষকে বড় করে তার কর্ম। মানুষ মরে গেলেও বেঁচে থাকে তার কর্মের মাধ্যমে। কর্মের জন্যই মানুষ ইতিহাসে অম্লান, অমর, সম্মাণিত হয়ে চিরকাল বহমান থাকে। যুগ-যুগান্তরে শতাব্দী ধরে অমরকৃতি মানুষের নাম, আর্দশ, কর্ম ও নীতিমালা প্রজন্মের মাঝে থাকে চিরঞ্জীব হয়ে। আমাদের এই দেশ ও জাতির মাঝে মহান স্বাধীনতার ঘোষক, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক, আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার, স্ব-নির্ভর বাংলাদেশের স্থপতি, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের প্রাণপুরুষ, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এর নাম তেমনি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, যুগ-যুগান্তরে শতাব্দী ধরে থাকবে। অমর-অম্লান শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর বর্ণাঢ্য জীবনের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা সময়ান্তে বা টাইম লাইনে নিম্নে উপস্থাপন করা হলো- (টাইমলাইনে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় সব অবদান তুলে ধরা হয় নি)

১৯৩৬ সালে ১৯ জানুয়ারী বগুড়া জেলার গাবতলি থানার বাগবাড়ীর লচিপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

পিতার নাম মনসুর রহমান, মাতার নাম জাহানারা খাতুন (রানী)। পিতা ছিলেন একজন কেমিস্ট, মাতা ছিলেন গৃহিণী ও সংগীত শিল্পী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ডাক নাম ছিল ‘কমল’।

পিতার চাকরি সূত্রে জিয়াউর রহমান এর শৈশবের বেশিরভাগ কাটে কলকাতার পার্ক সার্কাসে। মাত্র চার বছর বয়সেই জিয়াউর রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতার র্পাক সার্কাসের আমিন আলী এ্যাভিনিউতে অবস্থিত শিশু বিদ্যাপীঠে। এক বছর এই বিদ্যালয়ে পড়া-লেখা করার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে কলকাতা থেকে ফিরে আসেন বগুড়ার গাবতলীর বাগবাড়ীতে এবং সেখানেই লেখাপড়া করেন। পরে পিতা-মাতা’র ইচ্ছায় ১৯৪৪ সালের দিকে কলকাতায় ফিরে যান এবং সেখানেই আবার লেখাপড়া শুরু করেন কলকাতার ‘হেয়ার স্কুলে’। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হলে পিতার চাকরি সূত্রে পরিবারের সাথে পাকিস্তানের করাচিতে যান। ১৯৪৮ সালে ১ জুলাই তিনি ‘করাচি একাডেমি স্কুল’-এ (বর্তমানে তাইয়েব আলী খালভী একাডেমী) সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং এই স্কুল থেকেই ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ম্যাট্রিক পাসের পর তিনি ভর্তি হন করাচির ডি. জে. কলেজে।

কলেজে পড়া অবস্থায় যুদ্ধফেরত তার এক সেনাবাহিনী চাচার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ‘অফিসার ক্যাডেট’ হিসেবে জিয়াউর রহমান যোগদান করে কর্মজীবন শুরু করেন এবং এই বছরেই ‘কমান্ডো ট্রেনিং’ লাভ করেন।

সেই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানীদের নীচু চোখে দেখতেন এবং এর প্রভাব সেনাবাহিনীর মধ্যেও ছিল। সেনাদের মধ্যে জিয়াউর রহমান ছিলেন বেশ তেজোদীপ্ত, বুদ্ধিদীপ্ত, সৎ, পরিশ্রমী ও সাহসী। সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানী আব্দুল লতিফ নামে এক ক্যাডেট ছিল। আব্দুল লতিফ শিক্ষা দিবেন বলে মুষ্ঠিযুদ্ধের আয়োজন করলেন। পূর্ব পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমান সেই মুষ্ঠিযুদ্ধে অংশ নিলেন। কিন্তু সেই যুদ্ধ ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী ছিল না। পাকিস্তানপন্থি প্রতিপক্ষকে ধূলোয় মিশে দিয়ে জিয়াউর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানী হয়ে দেশের জন্য (সেনাবাহিনীতে ছোট্ট পরিসরে হলেও) প্রথম বিজয় (ভাষার বিজয় হয় ১৯৫৬ সালে গঠনতন্ত্রে স্থান পেলে-সে পেক্ষিতে) ছিনিয়ে আনেন।

১৯৫৫ সালে জিয়াউর রহমান ‘সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট’ পদে কমিশন পদ লাভ করেন। এরপর তিঁনি ‘প্যারাট্রুপার’ হিসেবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হন এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য তাঁকে বিদেশে পাঠানো হয়।

জিয়াউর রহমান ১৯৬০ সালে খালেদা খানম এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৬৩ সালে ‘ডিএফআই অর্থাৎ সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ’-এ যোগদান করেন।

জিয়াউর রহমান প্রথম বাবা হন ১৯৬৫ সালের ২০ শে নভেম্বর (বিএনপি’র সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান এর জন্মদিন) এবং দ্বিতীয়বার বাবা হন ১৯৭০ সালের ১২ ই আগস্ট ( মরহুম আরাফাত রহমান কোকো’র জন্মদিন)।

১৯৬৫ সালে ১৭ সেপ্টেম্বর ‘পাক-ভারতযুদ্ধ’ (কারগিল যুদ্ধ) শুরু হলে জিয়াউর রহমান ‘খেমকারান’ রণাঙ্গনের বেদীয়ান-এ যুদ্ধরত ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে’ এর একটি ব্যাটালিয়ন কোম্পানি-‘আলফা কোম্পানি’র “কমান্ডার” এর দ্বায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এ যুদ্ধে পাকি-সেনারা পিছু হটলেও জিয়াউর রহমান এর চৌকস ও দক্ষ নেতৃত্বে একমাত্র বাঙালী এ ব্যাটালিয়ন কোম্পানি যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীকে পরাজিত করে জয়লাভ করেন এবং এ বিজয়ের ফলে পাকসেনা বাহিনীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক বীরত্ব পদক লাভ করেন। বীরত্বের জন্য পাকিস্তান সরকার জিয়াউর রহমানকে “হিলাল-ই-জুরাত” খেতাবে ভূষিত করেন এবং জিয়াউর রহমান দু’টি ‘সিতারা-ই-জুরাত’ ও নয়টি ‘তাঘমা-ই-জুরাত’ মেডেল লাভ করেন।

এরপর জিয়াউর রহমান ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের মিলিটারি একাডেমিতে পেশাদার ‘ইনস্ট্রাকটর’ হিসেবে নিয়োগ পান এবং একই বছরে পশ্চিম পাকিস্তান স্টাফ কোয়ার্টার কলেজে কমান্ডো কোর্সে যোগ দেন।

অতঃপর ১৯৬৯ সালে এপ্রিল মাসে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীতে ‘মেজর পদ’-এ পদোন্নতি পেয়ে জয়দেবপুর সাব-ক্যান্টনমেন্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাটালিয়নে ‘সেকেন্ড-ইন-কমান্ড’ পদে যোগদান করেন এবং একই বছরে এডভান্সড মিলিটারি এন্ড কমান্ড ট্রেনিং কোর্সে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য পশ্চিম জার্মানিতে যান। সেখানে কয়েক মাস ব্রিটিশ আর্মির সাথেও কাজ করেন। এরপর দেশে ফিরে এসে আবার স্বীয় দ্বায়িত্বে যোগদান করেন।

১৯৬৯-৭০-সালে এ দেশে এক অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিদ্যামান ছিল। সবত্র মিছিল, মিটিং আর বিক্ষোভ চলছিল। এমন অবস্থায় ১৯৭০ সালে সেপ্টেম্বরে জিয়াউর রহমানকে বদলি করা হয় চট্টগ্রামে নবগঠিত ‘অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট’-এ ‘সেকে–ইন-কমান্ড’ পদের দ্বায়িত্ব দিয়ে।

১৯৭১ সালে ২৫/২৬ মার্চ রাত প্রায় ১টায় কমান্ডিং অফিসার লেঃ কর্নেল জানজুয়া মেজর জিয়াকে দ্রুত চট্টগ্রাম বন্দরে জেনারেল আনসারীর কাছে রির্পোট করতে বলেন। মেজর জিয়া যাওয়ার পথে ব্যারিকেড দেখতে পান এবং ঐ সময় ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান মেজর জিয়ার কাছে ঢাকার খবর বলেন, ‘ইপিআর হেড কোর্য়াটার আর রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পাক সেনারা হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। পাক সেনারা ততক্ষণে চট্টগ্রামেও হত্যা যজ্ঞ শুরু করেছে।’ মেজর জিয়াউর রহমান তখন ‘রিভোল্ট’ ঘোষণা করলেন এবং ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে বিদ্রোহের নির্দেশনা দিয়ে পাঠিয়ে মেজর জিয়া নিজে ষোলশহর বাজারে রাইফেল তাক করে সব পশ্চিম পাকিস্তানী-সেনাদেরকে ডিসআর্ম করলেন এবং বন্দি করলেন। অতপর মেজর জিয়া গভীর রাতে কমান্ডিং অফিসার জানজুয়ার বাসায় গিয়ে তাকে গ্রেফতার করেন এবং এরপর চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এ বিষয়ে পাক হানাদার বাহিনীর জেনারেল রাও ফরমান আলী তার ‘বাংলাদেশের জন্ম’ বইতে-৮৭ পৃষ্টায় লিখেছেন, “প্রতিটি বাঙ্গালী ইউনিটিই বিদ্রোহ করেছিল, মেজর জিয়াউর রহমান তার কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জানজুয়াকে হত্যা করেছিলেন এবং নিজেকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালে ২৬ শে মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে নিজেকে ‘হেড অব স্ট্রেট’ ঘেষণা দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। যা পরবর্তীতে ২৭,২৮,২৯,৩০ মার্চ পর্যন্ত কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত হয়। ঘোষণাটি বাংলা ও ইংরেজী দুই ভাষাতেই পাঠ করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, তৃতীয় খণ্ডে বর্ণিত জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাটি নিম্নরূপ-

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
প্রিয় সহযোদ্ধা ভাইয়েরা,
আমি, মেজর জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশের প্রভিশনাল প্রেসিডেন্ট ও লিবারেশন আর্মি চীফ হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। বাংলাদেশ স্বাধীন। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে নেমেছি। আপনারা যে যা পারেন সামর্থ্য অনুযায়ী অস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। আমাদেরকে যুদ্ধ করতে হবে এবং পাকিস্তানী বাহিনীকে দেশ ছাড়া করতে হবে।
ইনশাল্লাহ, বিজয় আমাদের সুনিশ্চিত।

১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসে মুক্তিযুদ্ধের জন্য দেশকে ১১ টি সেক্টরে ভাগ করা হলে মেজর জিয়াউর রহমান ১নং সেক্টরের (চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ফেনীর একাংশ নিয়ে ১ নং সেক্টর) দ্বায়িত্ব পেলে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যান।

যুদ্ধকে আরো বেগবান করার ও চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের লক্ষে ১৯৭১ সালে জুলাই মাসে ৩টি ব্রিগেড ফোর্স গঠন করা হয় এবং জিয়া’র নামের আদ্যক্ষর জেড দিয়ে ‘জেড-ফোর্স’ গঠন করা হয়-যার দ্বায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে। মেজর জিয়াউর রহমান ০৭ জুলাই হতেই ‘জেড-ফোর্সে’র নেতৃত্বে সমগ্র সিলেট, ময়মুনসিংহসহ কুড়িগ্রামের কিয়দংশ ও আরো অন্যান্য অংশে বীরত্বের সঙ্গে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন। অতঃপর ১৬ ই ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়।

দেশ স্বাধীনের পর তৎকালীন রাজনীতিবিদরা দেশ পরিচালনা করেন এবং মেজর জিয়াউর রহমান স্ব-পদে ফিরে যান। মেজর জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব অবদান রাখার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে মেজর জিয়াউর রহমান ‘কর্নেল’ পদে এবং এই বছরেই জুন মাসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘ডেপুটি-চীফ অব স্টাফ’ হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে নিযুক্ত হন।

১৯৭৩ সালের মাঝামাঝিতে ‘ব্রিগেডিয়ার’ এবং পরে একই বছরে ‘মেজর জেনারেল’ হিসেবে পদোন্নতি প্রাপ্ত হন। এরপরও তাঁকে ডিঙিয়ে সে সময় লেঃ জেঃ শফিউল্লাহ কে সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়।

১৯৭৫ সালে ২৫ আগস্ট জিয়াউর রহমান ‘চিফ অফ আর্মি স্টাফ’ নিযুক্ত হন।

এরপর ১৯৭৫ সালে ৭ নভেম্বরে ‘সিপাহি-বিপ্লব’ ঘটলে এর মাধ্যমে সিপাহি-জনতা খালেদ মোশাররফ নেতৃত্বাধীনদের পরাভূত করে জিয়াউর রহমানকে বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করেন এবং পরে জিয়াউর রহমানকে ‘উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক’ হিসেব ঘোষণা করা হয়।

১৯৭৬ সালে ২৯ নভেম্বর জিয়াউর রহমান ‘প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক’ হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৭ সালে ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এর কাছ থেকে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্টের দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্টের দ্বায়িত্বভার গ্রহণ করার পর দেশকে সমৃদ্ধশালী, স্ব-নির্ভর, ও উন্নতির কাতারে নিয়ে যাওযার লক্ষে ১৯৭৭ সালে ৩০ এপ্রিল ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দুর্ভিক্ষ-দারিদ্র্যপীড়িত এ দেশে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে “১৯ দফা” পেশ করেছিলেন-তা ছিল এদেশের গণমানুষের মুক্তির সনদ; দেশে আজ অবধি যতো উন্নয়ন বা উন্নতিই হোক না কেন তা আজো মনেহয় সেই “১৯ দফা’রই বহিঃপ্রকাশ? ঊনিশ দফা কর্মসূচি নিচে উল্লেখ করা হলো-

১.সর্বোতভাবে দেশের স্বাধীনতা, অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা।

২.শাসনতন্ত্রের চারটি মূলনীতি অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি সর্বাত্মক বিশ্বাস ও আস্থা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার সমাজতন্ত্র -জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে প্রতিফলন করা।

৩.সর্ব উপায়ে নিজেদেরকে একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসাবে গড়ে তোলা।

৪.প্রশাসনের সর্বস্তরে উন্নয়ন কার্যক্রমে এবং আইন শৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

৫.সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামীণ তথা জাতীয় অর্থনীতিকে জোরদার করা।

৬.দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা এবং কেহ যেন ভূখা না থাকে, তার ব্যবস্থা করা।

৭.দেশে কাপড়ের উৎপাদন বাড়িয়ে সকলের জন্যে অন্তত মোটা কাপড় সরবরাহ নিশ্চিত করা।

৮.কোন নাগরিক যেন গৃহহীন না থাকে, তার যথাসম্ভব ব্যবস্থা করা।

৯.দেশকে নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করা।

১০.সকল দেশবাসীর জন্যে ন্যূনতম চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা।

১১.সমাজে নারীর যথাযোগ্য মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা এবং যুবসমাজকে সুসংহত করে জাতি গঠনে উদ্বুদ্ধ করা।

১২.দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বেসরকারি খাতে প্রয়োজনীয় উৎসাহ দান।

১৩.শ্রমিকদের অবস্থার উন্নতি সাধন এবং উৎপাদন বৃদ্ধির স্বার্থে সুস্থ শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক গড়ে তোলা।

১৪.সরকারি চাকরিজীবিদের মধ্যে জনসেবা ও দেশ গঠনের মনোবৃত্তি উৎসাহিত করা এবং তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন করা।

১৫.জনসংখ্যা বিস্ফোরণ রোধ করা।

১৬.সকল বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সমতার ভিত্তিতে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা এবং মুসলিম দেশগুলির সাথে সম্পর্ক জোরদার করা।

১৭.প্রশাসন এবং উন্নয়ন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা।

১৮.দুর্নীতিমুক্ত ন্যায়-নীতিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা।

১৯.ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের অধিকার পূর্ণ সংরক্ষণ করা এবং জাতীয় ঐক্যে ও সংহতি সুদৃঢ় করা।

উনিশ দফা কর্মসূচি পেশ করার পর থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রায়ন ও উন্নয়নের জন্য একের পর এক কাজ করে গেছেন এবং একটা ভালো ভিত গড়ে দিয়েছেন। কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, কারিগরি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, আর্ন্তজাতিক এমন কোন সেক্টর নেই যে, অল্প সময়ের মধ্যেই সেখানে জিয়াউর রহমান এর হাত লাগে নি।

রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্ব নেওয়ার ৪০ দিন পর অর্থাৎ ১৯৭৭ সালে ৩০ মে জিয়াউর রহমান স্বাধীন দেশে প্রথম ‘হ্যাঁ-না’ ভোট করেন-যা ছিল “গণতন্ত্রের বীজ বপন” এবং ৯৯% হ্যাঁ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হন।

১৯৭৮ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে তিঁনি উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে প্রধান করে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) প্রতিষ্ঠা করেন। ছয়টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবং ১৯৭৮ সালে ৩ রা জুনের এ নির্বাচনে তিঁনি ৭৬.৬৭ % ভোট পেয়ে বিজয়ী হন এবং পুনঃরায় রাষ্ট্রপতি বা প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োজিত থাকেন এবং স্বাধীন দেশের জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত প্রত্যক্ষ ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট হন এবং ১লা মে ১৯৭৮ সাল থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়া রাজনৈতিক দলগুলোর উপর থেকে বিধি-নিষেধ তুলে নেন। জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানের রেখে যাওয়া রাষ্ট্র-যেখানে মানুষের অধিকার, মর্যাদা ভূ-লুণ্ঠিত, গণতন্ত্র নির্বাসিত, বিশৃঙ্খলাপূর্ণ ও শান্তিশৃঙ্খলাহীন এবং একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ বিলুপ্ত করে বহুদলীয় গণতন্ত্র এর প্রবর্তন করেন অর্থাৎ গণতন্ত্রের ভিত গড়েন এবং নতুন যুগোপযোগী রাজনীতির সূচনা করেন। যার ফলে আওয়ামী লীগও আবার নতুনভাবে আওয়ামী রাজনীতি করার সুযোগ পায়।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর বিভিন্ন দলের মোর্চা এই ফ্রন্ট একীভূত করে ১৯৭৮ সালে ০১ সেপ্টেম্বর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেন-যার মূল চেতনা ছিল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। তিনি বাংলাদেশের বাঙালি-অবাঙালি, বেদে-সাঁওতাল, চাকমা, গাড়ো, খাসিয়া, মণিপুরি প্রভৃতি সকল জাতি-উপজাতির জনগোষ্ঠীকে ভাষা, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত এর সব কিছুর ঊর্র্ধ্বে সকল নাগরিকের প্রথম রাষ্ট্রীয় পরিচয় “বাংলাদেশি” পরিচয়কে তুলে ধরেন এবং দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খা ও প্রত্যাশাকে সম্মান করে “বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ” সংবিধানে প্রতিস্থাপন করেন- যেখানে আমাদের নৃ-তাত্ত্বিক পরিচয় অক্ষুণ্ণ থাকে।

অতঃপর ১৯৭৯ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারীতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি জাতীয় সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২২০টি আসন লাভ করে বিজয়ী হয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যখন তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ ঘুচিয়ে দেশকে ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন-যখন প্রেসডেন্ট জিয়াউর রহমানকে অনেকে ফ্রান্সের বীর দ্য গল এর সাথে তুলনা করতেছিলেন, তখন ১৯৮১ সালে ৩০ মে গভীর রাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তিঁনি নিহত হন।

১৯৮১ সালে ৩১ মে ঢাকার মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লক্ষ লক্ষ লোক কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এসেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর জানাজায় শরীক হতে। সেই জানাজার লোক সমাগম আজো বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জানাজা বলে পরিচিত। দেশের এমন কেউ ছিল না যে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর জন্য সে দিন দোঁয়া করেন নি। এখানে একটা ঘটনা উল্লেখ করলে এর গভীরতা বুঝা যাবে। এক ভিখারিণী বুড়ি-মা এসেছিলেন সে দিন মানিক মিয়া এ্যাভিনিউতে-যে বুড়ি মা-(‘প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় জিয়া ১৯৭৮ সালে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানায় ঝিটকা এলাকায় নিজ হাতে খাল কাটতে গিয়েছিলেন। খাল কাটার এক ফাঁকে পেসিডেন্ট জিয়া যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন এক ভিখারিণী বুড়ি মা প্রেসিডেন্ট জিয়া’র নাম শুনে এসেছিলেন জিয়াকে দেখতে। কেননা, জিয়া নামের তার এক ছেলে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে। এসব শুনে প্রেসিডেন্ট জিয়া বুড়ি মাকে বুকে টেনে জড়িয়ে ধরেন এবং বুড়ি মাও প্রেসিডেন্ট জিয়াকে গভীর মমতায় নিজের পেটের ছেলের মতো জড়িয়ে ধরেন এবং এরপর বুড়ি মা জিয়াকে নিজের কুঁেড় ঘরে নিয়ে গিয়ে ভিক্ষার দশ মিশালী চালের ভাত বিভিন্ন প্রকার পাঁচমিশালী শাখ দিয়ে লোকমা করে নিজ হাতে খাওয়ান। প্রেসিডেন্ট জিয়াও সে খাবার খেয়ে তৃপ্তি পান’)-সে বুড়ি মা সে দিন বুক থাপড়িয়ে মাতম করতে করতে বলতে থাকেন-“হায় আমার জিয়া, হায় আমার জিয়া, তুই আমায় ছেড়ে কই গেলিরে বাছা”। ভিড়ের মধ্যে লোকজনকে ধরে ধরে বলেন-‘তোমরা আমার জিয়াকে দেখছো’। এরপর বুড়ি মা আর ঘরে ফিরে যান নি, যতো দিন বেঁচে ছিলেন জিয়ার মাজার ও জিয়া উদ্যানের আশেপাশে ঘুর ঘুর করতে করতে পাগলিনীবেশে একদিন পরপারে চলে যান।

এভাবেই ৩০ মে ১৯৮১ সালে জিয়া তার কোটি কোটি অনুসারীদের রেখে চলে যান পরপারে কিন্তু তিঁনি আজো আছেন অমর-অম্লান বা চিরঞ্জীব হয়ে।। অজো বহু মানুষ জিয়ার জন্য কেঁদে কেঁদে দোঁয়া করেন আর আফসোস করেন। …..‘পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ তায়ালা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে বেহেস্ত নসিব করুন’- এই প্রার্থনায় ৩০ মে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর মৃত্যু বার্ষিকীতে-এই লেখা শেষ করছি।

লেখকঃ মোঃ মিজানুর রহমান-সাংবাদিক, কবি ও কলামিস্ট।

জিয়া লাইব্রেরী অনলাইন
Logo