জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় নিজের নামে একটি কলাম লেখেন । হুবহু পড়ুন জিয়াউর রহমানের সেই লেখাটি ।
এই লেখাটি অনেক অনাকাঙ্খিত বিতর্কের অবসান করবে আশা করি । বিশেষ করে স্বাধীনতার ঘোষনা নিয়ে বিতর্ক ।
********************************************************************
ফেব্রুয়ারীর (১৯৭১ ) শেষ দিকে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্হিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠেছিল তখন আমি এক দিন খবর পেলাম , তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের সৈনিক রা চট্রগ্রাম শহরের বিভিন্ন সহানে ছোট ছোট বিভক্ত হয়ে বিহারী দের বাড়ীতে বাস করতে শুরু করেছে । খবর নিয়ে আমি আর ও জানলাম , কমান্ডোরা বিপুল পরিমান অস্র সস্র আর গোলাবারুদ নিয়ে বিহারী বাড়ীগুলোতে জমা করছে । এবং রাতের অন্ধকারে বিপুল সংখ্যায় তরুন বিহারীদের সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে ।
এসব কিছু থেকে এরা যে ভয়ংকর রকমের অশুভ একটা কিছু করবে, তার সু স্পষ্ট আভাসই আমরা পেলাম । তার পর এলো ১ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানের উদাও আহবানে সারাদেশে শূরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন । এর পর দিন দাংগা হলো। বিহারীরা হামলা করেছিল এক শান্তিপূর্ন মিছিলে । এর থেকে আর ও গোলযোগের সুচনা হলো । এই সময়ে আমার ব্যাটেলিয়নের নিরাপত্তা এনসিওরা আমাকে জানালো বিংশতম বালুচ রেজিমেন্টের জোয়ানরা বেসামরিক পোষাক পরে বেসামরিক ট্রাকে চড়ে কোথায় যেন যায় । তারা ফিরে আসে আবার শেষ রাতের দিকে । আমি উৎসুক হলাম ।লোক লাগালাম খবর নিতে । খবর নিয়ে জানলাম প্রতিরাতেই তারা যায় কতকগুলুনিদৃষ্ট বাঙালী পাড়ায় । নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে বাঙালীদের । এসময় প্রতি দিনই চুরিকাহত বাঙালীদের হাসপাতালে ভর্তি হতে শোনা যায় ।
এই সময় আমাদের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জানযুয়া আমার গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখার জন্যেও লোক লাগায় । মাঝে মাঝেই তার লোকেরা যেয়ে আমার সম্পকে খোঁজ খবর নিতে শুরু করে ।আমরা তখন আশংকা করছিলাম , আমাদের হয়তো নিরশ্র করা হবে ।আমি আমার মনোভাব দমন করে কাজ করে যাই এবং নিরশ্র করার উদ্যোগ ব্যার্থ করে দেয়ার সম্ভব্য সব ব্যাবস্হা গ্রহন করি । বাঙালী হত্যা এবং বাঙালী দোকান পাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ক্রমেই বাড়তে থাকে ।
আমাদের নিরশ্র করার চেষ্টা করা হলে আমি কি ব্যাবস্হা গ্রহন করবো কর্নেল (তখন মেজর )শওকত আমার কাছে জানতে চান । ক্যাপ্টেন শমসের মবিন এবং মেজর খালেকুজজমান আমাকে জানান যে , স্বাধীনতার জন্যে আমি যদি অস্র তুলে নেই , তাহলে তারাও দেশের মুক্তির জন্যে প্রান দিতে কুন্ঠা বোধ করবেননা । ক্যাপ্টেন ওলি আহমদ আমাদের মাঝে খবর আদান প্রদান করতেন । জেসিও এবং এনসিওরাও দলে দলে বিভক্ত হয়ে আমার কাছে আসতে থাকে । তারাও আমাকে জানায় যে , কিছু একটা না করলে বাঙালী জাতি চির দিনের জন্যে দাসে পরিনত হবে । আমি নিরবে তাদের কথা শুনলাম । কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম , উপযুক্ত সময় এলেই আমি মুখ ঘুরাবো । সম্ভবত ৪ মার্চ আমি ক্যাপ্টেন ওলি আহমদ কে ডেকে নেই ।আমাদের ছিল সেটা প্রথম বৈঠক । আমি তাকে সোজাসুজি বললাম সশস্র সংগ্রাম শুরু করার সময় দ্রুত একমত হন । আমরা পরিকল্পনা তৈরী করি এবং প্রতিদিনই আলোচনা বৈঠকে মিলিত হতে থাকি ।
” ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষনা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলো” । আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চুড়ান্ত রুপ দিলাম । কিন্তু তৃতীয় কোন ব্যাক্তিকে তা জানালাম না ।বাঙালী এবং পাকিস্তানি সৈনিক দের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠছিল ।১৩ মার্চ শুরু হলো বঙ্গবন্ধু সাথে আলোচনা । আমরা সবাই ক্ষণিকের জন্যে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম । আমরা আশা করলাম পাকিস্তানি নেতারা যুক্তি মানবে এবং পরিস্হিতির উন্নতি হবে ।কিন্তু দুর্ভাগ্য জনক ভাবে পাকিস্তানিদের সামরিক প্রস্তুতি হ্রাস না পেয়ে দিন দিন বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো ।প্রতি দিনই পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানী করতে লাগলো । বিভিন্ন স্হানে জমা হতে থাকল অশ্র সশ্র আর গোলাবারুদ । সিনিয়র পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররা সন্দেহ জনকভাবে বিভিন্ন গ্যারসিনে আসা যাওয়া শুরু করলো । চট্রগ্রামে নৌ-বাহিনীতে শক্তি বৃদ্ধি করা হলো ।
১৭মার্চ স্টেডিয়ামে ইবিআরসির লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এম আর চৌধুরী , আমি , ক্যাপ্টেন ওলি আহমদ ও মেজর আমিন চৌধুরী এক গোপন বৈঠকে মিলিত হলাম ।এক চুড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহন করলাম । লেঃ কর্ণেল চৌধুরীকে অনুরোধ করলাম নেতৃত্ব দিতে । দু’দিন পর ক্যাপ্টেন (এখন মেজর) রফিক আমার বাসায় গেলেন এবং ইপিআর বাহিনীকে সঙ্গে নেওয়ার প্রস্তাব দিলেন । আমরা ইপিআর বাহিনীকেও পরিকল্পনাভুক্ত করলাম । এরমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীও সামরিক তৎপরতা শুরু করার চুরান্ত প্রস্তুতি গ্রহন করলো ।
২১ মার্চ জেনারেল আব্দুল হামিদ খান গেল চট্রগ্রাম ক্যান্টমেন্টে । চট্রগ্রামে সামরিক ব্যাবস্হা গ্রহনর চুড়ান্ত পরিকল্পনা প্রনয়নই তার এই সফরের উদ্দেশ্য । সেদিন ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভোজ সভায় জেনারেল হামিদ ২০তম বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাতমি কে বললেন, ” ফাতমি , সংক্ষেপে , ক্ষিপ্রগতিতে আর যত কম সংখ্যক লোক ক্ষয় করে কাজ সারতে হবে” ।আমি এই কথা গুলো শুনেছিলাম ।
২৪ মার্চ বিগ্রেডিয়ার মজুমদার ঢাকায় চলে গেলেন । সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী শক্তি প্রয়োগে চট্রগাম বন্দরে যাওয়ার পথ করে নিল। জাহাজ সোয়াত থেকে অশ্র নামানোর জন্যই বন্দরের দিকে ছিল তাদের এই অভিযান । পথে জনতার সাথে গঠলো তাদের কয়েক দফা সংঘর্ষ । এতে নিহত হলো বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী । দীর্ঘ প্রতিক্ষিত সসশ্র সংগ্রাম যে কোন মুহূর্তে শুরু হতে পারে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম । মানসিক দিক থেকে আমরা ছিলাম প্রস্তুত ।পরের দিন আমরা পথের ব্যারিকেড সরাতে ব্যস্ত ছিলাম । তার পর এলো সেই কালরাত ।
২৫ও ২৬ মার্চে র মধ্যবর্তী কালরাত । রাত ১১ টায় আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে নির্দেশ দিলো নৌ বাহিনীর ট্রাকে করে চট্রগ্রাম বন্দরে গিয়ে জেনারেল আনসারির কাছে রিপোর্ট করতে । আমার সাথে নৌ বাহিনীর পাকিস্তানী প্রহরি থাকবে তাও জানানো হলো । আমি ইচ্ছে করলে আমার সাথে আমার তিনজন লোক নিয়ে যেতে পারি ।তবে আমার সাথে আমারই ব্যাটেলিয়ানের একজন পাকিস্তানি অফিসার ও থাকবে । অবস্য কমান্ডিং অফিসারের মতে সে যাবে আমাকে গার্ড দিতেই । এ আদেশ পালন করা আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব । আমি বন্দরে যাচ্ছি কিনা তা দেখার জন্য এক জন লোক ছিল ।আর বন্দরে আমার প্রতিক্ষায় ছিল জেনারেল আনসারি । হয়তোবা আমাকে চিরকালের জন্যই স্বাগত জানাবে । আমরা বন্দরের পথে বেরুলাম । আগ্রাবাদে আমাদের থামতে হলো । পথে ছিলো ব্যারিকেড । এ সময় সেখানে এলো মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী । ক্যাপ্টেন ওলি আহমদ এর কাছ থেকে এক বার্তা নিয়ে এসেছে । আমি রাস্তায় হাটছিলাম । খালেক আমাকে একটু দুরে নিয়ে গেল । কানে কানে বললো , তারা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে । বহু বাঙালীকে তারা হত্যা করেছে । এটা ছিল একটা সিদ্ধান্ত গ্রহনের চুড়ান্ত সময় । কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমি বললাম আমরা বিদ্রোহ করলাম ………
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে আমি বললাম আমরা বিদ্রোহ করলাম । তুমি ষোল শহর বাজারে যাও । ওলি আহমদকে বলো ব্যাটেলিয়ান তৈরী রাখতে, আমি আসছি । আমি নৌ -বাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে গেলাম । পাকিস্তানী বাহিনী অফিসার নৌ- বাহিনীর চীফ পোর্ট অফিসার ও ড্রাইভারকে জানালাম যে আমাদের আর বন্দরে যাবার দরকার নাই । এতে তাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে আমি পান্জাবী ড্রাইভার কে গাড়ী ঘুরাতে বললাম । ভাগ্য ভালো যে, সে আমার আদেশ মানলো । আমরা আবার ফিরে চললাম । ষোল শহর বাজারে পৌঁছেই আমি গাড়ী থেকে লাফিয়ে নেমে একটা রাইফেল তুলে নিলাম । পাকিস্তানী অফিসারটির দিকে তাক করে বললাম , হাত তোল , আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম ।
নৌ বাহিনীর লোকেরা এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো । পর মুহূর্তেই আমি নৌ- বাহিনীর অফিসারের দিকে রাইফেল তাক করলাম । তারা ছিল আট জন । সবাই আমার নির্দেশ মানলো এবং অশ্র ফেলে দিলো । আমি কমানিডং অফিসারের জীপ নিয়ে তার বাসার দিকে রওনা দিলাম । তার বাসায় পৌঁছে হাত রাখলাম কলিং বেলে । কমান্ডিং অফিসার পাজামা পরেই বেরিয়ে এলো । খুলে দিলো দরজা । ক্ষিপ্রগতিতে আমি ঘরে ডুকে পরলাম এবং গলাশুদ্ধ তার কলার টেনে ধরলাম । দ্রূতগতিতে আবার দরজা খুলে কর্ণেলকে আমি বাইরে টেনে আনলাম । বললাম , বন্দরে পাঠিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিলে ? এই আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম ।লক্ষি সোনার মতো আমার সঙ্গে এসো । সে আমার কথা মানলো । আমি তাকে ব্যাটলিয়নে নিয়ে এলাম । অফিসারদের মেসে যাওয়ার পথে আমি কর্ণেল শওকতকে (তখন মেজর ) ডাকলাম ।তাকে জানালাম আমরা বিদ্রোহ করেছি । সে আমার সাথে হাত মিলালো ।
ব্যাটলিয়নে ফিরে দেখি , সমস্ত পাকিস্তানি অফিসারকে বন্ধি করে একটা ঘরে রাখা হয়েছে । আমি অফিসে গেলাম । চেষ্ঠা করলাম লেফটেনেন্ট এম আর চৌধুরীর সাথে আর মেজর রফিকের সাথে যোগাযোগ করতে । কিন্তু পারলাম না । সব চেষ্ঠা ব্যার্থ হলো । তার পর রিং করলাম বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটারকে । তাকে অনুরোধ করলাম ডেপুটি কমিশনার , পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, কমিশনার , ডিআইজি এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়ন বিদ্রোহ করেছে । বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যদ্ধ করবে তারা ।
এদের সবার সাথেই আমি টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি কিন্তু কাউকেই পাইনি । তাই টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমেই আমি তাদের খবর দিতে চেয়েছিলাম । অপারেটর সানন্দে আমার অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হলো । সময় ছিলো অতি মূল্যবান ।আমি ব্যাটলিয়নের অফিসার জেসিও আর জওয়ানদের ডাকলাম । তাদের উদ্দেশ্যে ভাষন দিলাম । তারা সবাই জানতো । আমি সংক্ষেপে সব বললাম এবং তাদের নির্দেশ দিলাম সশশ্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে । তারা সর্বসম্মতিক্রমে হৃষ্ট চিত্তে এ আদেশ মেনে নিল । আমি তাদের একটা সামরিক পরিকল্পনা দিলাম । তখন রাত ২ টা বেজে ১৫ মিনিট ।২৬মার্চ ১৯৭১ সাল ।রক্তের অক্ষরে বাঙালীর হৃদয়ে লেখা একটি দিন ।বাংলা দেশের জনগন চিরদিন স্মরণ রাখবে এই দিনটিকে । স্মরণ রাখতে ভালোবাসবে । এই দিনটিকে তারা কোন দিন ভুলবেনা, কো- ন -দি- ন না ।