জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক :১৯৯১ সালের ২০ মার্চ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথবারের মতো শপথ নেওয়ার ৩৯ দিনের মাথায় শতাব্দীর অন্যতম ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস দক্ষিণ বাংলাদেশের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আঘাত হানে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন সামগ্রীর অপ্রতুলতা সত্ত্বেও সরকার দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিকে দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করে। খালেদা সরকারের প্রথম মেয়াদে মূল্যস্ফীতির হারকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং শিল্প ও কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা হয়। খালেদা সরকার দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৯১ সালে একটি নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করা হয়, যার মাধ্যমে বেসরকারি বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ব্যক্তিখাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটে, বিশেষত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে। এতে কোনোপ্রকার বাধানিষেধ ছাড়াই শতভাগ বিদেশি মালিকানা ও যৌথ বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হয়। খালেদা সরকার পশুসম্পদ খাতকে সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করে, যার ফলে দেশব্যাপী অসংখ্য গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগীর খামার গড়ে ওঠে। এসময় দেশে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক মুদ্রাকে আংশিক বিনিময়যোগ্য করা হয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণও সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। দেশের উন্নয়ন বাজেটে বিদেশি সহায়তার উপর নির্ভরশীলতা হ্রাসে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেয়া হয়। এর ফলে পাঁচ বছরে উন্নয়ন বাজেটে দেশিয় সম্পদের হিস্যা ২১ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ শতাংশে দাঁড়ায়। ১৯৯৩-৯৪ অর্থবছরে দেশে প্রথমবারের মতো উৎপাদন ও আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তন করা হয়, যার মাধ্যমে রাজস্ব আহরণের নতুন দুয়ার উন্মুক্ত হয়। পাশাপাশি, সরকারের মুক্ত-বাজার ও বাণিজ্যিক উদারিকরণ নীতিমালার অংশ হিসেবে আমদানি পর্যায়ে ব্যাপক হারে শুল্ক হ্রাস করা হয়।
এসময়ে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধি ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে খাল-খনন কর্মসূচি পুনরায় চালু করা হয়। চতুর্থ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে (১৯৯০-৯৫) শিক্ষা খাতের অনুকূলে সর্বোচ্চ বরাদ্দ রাখা হয় যার ৭০ শতাংশই ছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপ-খাতের জন্য। খালেদা সরকার একটি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে এবং উচ্চ শিক্ষা উৎসাহিত করার জন্য ব্যক্তিখাতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা অনুমোদন করে। দেশের মানুষকে দ্রুততম সময়ে স্বাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি পৃথক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৯৩ সালের ১ জুলাই থেকে দেশব্যাপী প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শিক্ষালাভে আগ্রহী করে তুলতে খালেদা সরকার ১৯৯৩ সালে ‘শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য’ কর্মসূচি চালু করে। পল্লী অঞ্চলে মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা হয় এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রীদের জন্য দেশব্যাপী একটি উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু করা হয়।
দেশের আইন ও বিধিবিধান অব্যাহতভাবে হাল-নাগাদ করার লক্ষ্যে খালেদা সরকার একটি স্থায়ী আইন কমিশন গঠন করে। দেশের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণেও নেওয়া হয় তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল: ১৯৯৪ সালের ১৬ অক্টোবর যমুনা বহুমুখী সেতুর ভৌত-নির্মাণ শুরু করা, মেঘনা-গোমতী সেতু নির্মাণের মাধ্যমে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাতায়াত নির্বিঘ্ন করা, চট্ট্রগ্রামে একটি অত্যাধুনিক রেলস্টেশন নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্য প্রকল্প গ্রহণ। এসময় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্পের প্রস্ত্ততিমূলক কাজ সম্পন্ন করা হয় এবং এগুলোর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে চীনা ও কোরীয় সংস্থার সাথে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে সপ্তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন এবং প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সার্কের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হওয়ায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়। গণমাধ্যমে অবাধ স্বাধীনতা থাকায় এসময় দেশে প্রকাশিত সংবাদপত্রের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে পড়ে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবার সিএনএন ও বিবিসি’র মতো স্যাটেলাইট চ্যানেলকে সম্প্রচার করার সুযোগ দেওয়া হয় এবং এর ধারাবাহিকতায় অন্যান্য আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলও দেশের আকাশসীমায় প্রবেশ করে। বাংলাদেশে মোবাইল টেলিফোনের যাত্রাও এসময়ে শুরু হয়।
খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদে গৃহীত কিছু উল্লেখযোগ্য প্রশাসনিক পদক্ষেপের মধ্যে ছিল: সরকারি চাকুরেদের বেতন ও ভাতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত জাতীয় বেতন কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স-সীমা ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ৩০ বছর করা; পেনশন অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজতর করা এবং সরকারি চাকুরেদের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিধবা ও সন্তানদের জন্য আজীবন পেনশনের বিধান করা; শ্রমিকদের জন্য ১৭টি খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ; বঙ্গোপসাগরে জলদস্যুতা ও চোরাচালান হ্রাসে কোস্ট-গার্ড বাহিনী প্রতিষ্ঠা; দেশের শেয়ারবাজার তদারকির জন্য সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন। এসময়ে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু পরিবেশে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির দিক দিয়ে তৃতীয় খালেদা সরকার (২০০১-০৬) দেশের জন্য আরো ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসে। ২০০২-০৬ সময়কালে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের উপরে থাকে। জনপ্রতি জাতীয় আয় ২০০০-০১ সালে ৩৭৪ মার্কিন ডলারের তুলনায় ২০০৫-০৬ সালে ৪৮২ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০০১ সালের ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০০৪-০৫ সালে ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। বিদেশ থেকে প্রেরিত রেমিটেন্সের পরিমান পাঁচ বছরে প্রায় তিনগুণ বেড়ে ২০০৬ সালে ৫ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। ২০০৫ সাল থেকে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপী এমএফএ কোটা বাতিল হলেও খালেদা সরকারের দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের তৈরি পোশাক খাতের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হয় নি। সরকারের বিনিয়োগ-বান্ধব নীতি ও কৌশলের কারণে শিল্পখাতে যে অগ্রগতি অর্জিত হয় তার ফলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মার্চেন্ট ব্যাংকার গোল্ডম্যান-স্যাক্স বাংলাদেশকে বিশ্বের দ্রুত উদীয়মান ১১টি দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, যাতে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের মতো দেশও অন্তর্ভূক্ত ছিল। ২০০২-০৬ সময়কালে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; ২০০৬ সালের মার্চ পর্যন্ত বিনিয়োগ বোর্ডে ৬২ হাজার কোটি টাকার ৯ হাজার শিল্প-প্রকল্প নিবন্ধিত হয়, যা পূর্ববর্তী পাঁচ বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ছিল। এর ফলে ২০০৫-০৬ সালে জিডিপি’তে শিল্পখাতের অবদান ১৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যায় এবং শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ অতিক্রম করে। ২০০৪-০৫ অর্থবছরে বন্ধ হয়ে যাওয়া ও লোকসানি আদমজী পাটকলের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের পাওনা টাকা পরিশোধের পর সেখানে একটি নতুন রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল চালু করা হয়।
জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যসমূহের সাথে সাযুজ্য রেখে খালেদা সরকার মধ্য-মেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে একটি ‘দারিদ্র নিরসন কৌশলপত্র’ প্রণয়ন করে। দারিদ্র নিরসনের জন্য বাজেট বরাদ্দের হার প্রতিবছরই বৃদ্ধি করা হয় এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে এর হিস্যা দাঁড়ায় মোট বাজেটের ৫৬ শতাংশ। পল্লী অঞ্চলে অতি দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র হ্রাসের জন্য সরকার সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি সম্প্রসারিত করে। দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গাপ্রবণ এলাকায় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৫০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়। চরাঞ্চলে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নয়নে ৫০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প (চর জীবিকায়ন কর্মসূচি) গ্রহণ করা হয়। এসময়ে দেশে দারিদ্রের হার ৯ শতাংশ হ্রাস পায়। সমাজের পশ্চাৎপদ ও অবহেলিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা মহিলাদের মাসিক ভাতা ও সুবিধাভোগীর সংখ্যা উভয়ই বৃদ্ধি করা হয়। বয়স্ক ভাতা ও ভাতাগ্রহীতার সংখ্যা উভয়ই বাড়ানো হয়। পরিবেশ সংরক্ষণেও খালেদা সরকার কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছিল। বিশ বছরের বেশি পুরনো বাস ও ট্রাককে রাস্তা থেকে উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং ২-স্ট্রোক ইঞ্জিনের ডিজেল-চালিত বেবী-ট্যাক্সি উঠিয়ে দিয়ে তাদের স্থলে ৪-স্ট্রোক ইঞ্জিন বিশিষ্ট সিএনজি চালিত বেবী-ট্যাক্সি রাস্তায় নামানো হয়। দেশব্যাপী পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।