জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : খালেদা সরকার শিক্ষাখাতেও কিছু সাফল্য অর্জন করে। প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির হার ৯৭ শতাংশে উন্নীত করা হয়, ছাত্রীদের শিক্ষা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক করা হয়, প্রায় দুই কোটি ছাত্রীকে শিক্ষা-উপবৃত্তির আওতায় আনা হয় এবং বিদ্যালয়সমূহে ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। মেয়েদের জন্য ২টি নতুন ক্যাডেট কলেজ ও ৩টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় চট্টগ্রামে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকায়নের পাশাপাশি খালেদা সরকার কওমি মাদ্রাসাসমূহের ‘দাওরা’ সনদকে স্বীকৃতি দেয় এবং ফাজিল ও কামিল ডিগ্রিকে ব্যাচেলর্স ও মাস্টার্স ডিগ্রির সমতূল্য ঘোষণা করে। উচ্চশিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়, যেগুলোর বেশিরভাগই ছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত। অনেকগুলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়; বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং দেশব্যাপী এধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫১ থেকে ৬৪টিতে উন্নীত করা হয়।
সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া ও এসংক্রান্ত অবকাঠামো উন্নয়নে খালেদা সরকার বেশ কয়েকটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। উপজেলা হাসপাতালগুলোতে শয্যাসংখ্যা ৩১ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়, নতুন জেলাশহরে শয্যাসংখ্যা ৫০ থেকে ১০০ এবং পুরনো জেলা শহরের হাসপাতাল ১০০ থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। তাছাড়া কয়েকটি নতুন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালও প্রতিষ্ঠা করা হয়। সরকারি পদক্ষেপের কারণে দেশে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়।
খালেদা সরকার টেলিযোগাযোগ খাত উন্নয়নের উপরও যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করে। তাঁর দায়িত্বগ্রহণের সময়কার প্রায় ৭ লক্ষের তুলনায় মেয়াদশেষে দেশে সরকারি ফিক্সড ফোনের সংখ্যা ১২ লক্ষ বিশ হাজারে উন্নীত হয়। বেসরকারি ফিক্সড ফোন সেবাগ্রহীতার সংখ্যাও ২০০৬ সালে দেড় লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। দেশের ৬৪টি জেলায় ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপন করা হয় এবং উপজেলাগুলোকে ধাপে ধাপে ডিজিটাল টেলিফোন নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়। খালেদার শাসনকালে দেশে ফিক্সড ও মোবাইল টেলিফোনের মোট সংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়ে যায়। টেলিফোন সংযোগ ও কলরেটের হার ব্যাপক হারে হ্রাস করা হয়। সাধারণ জনগণের কাছে ফিক্সড ফোন সহজলভ্য করতে ১৭টি বেসরকারি কোম্পানিকে ফিক্সড ফোন সেবা প্রদানের লাইসেন্স দেওয়া হয়। পাশাপাশি, সরকারি মালিকানাধীন টেলিটক কোম্পানিও সাধারণ জনগণকে মোবাইল টেলিফোন সেবা প্রদান করে। একটি সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে সংযুক্তির মাধ্যমে এসময়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক তথ্য মহাসড়কের সাথেও সংযুক্ত হয়। এর ফলে বৈদেশিক যোগাযোগ, উপাত্ত বিনিময় ও ইন্টারনেট যোগাযোগ দ্রুততর, সস্তা ও সহজলভ্য হয়।
যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে খালেদা সরকার তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেয় নি, এসময়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য দেশে ৮৯ হাজার কিলোমিটার নতুন ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপন করা হয়। বিদ্যুৎ গ্রাহকের হার এসময়ে ৭৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৭ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়। কড়াকড়ি আরোপের কারণে বিদ্যুৎ খাতে সিস্টেম লস ২৮ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২২ শতাংশে নেমে আসে। প্রায় ৫০ হাজার গ্রাম পল্লী বিদ্যুতায়নের আওতায় চলে আসে। খালেদা জিয়া সরকার ১৫টি নতুন উপজেলা সৃষ্টি করে, যার ফলে উপজেলার সংখ্যা ৪৮০তে উন্নীত হয়। সরকার প্রথমবারের মতো কর ন্যায়পালের পদটিও সৃষ্টি করে।
খালেদা জিয়ার সরকারের তৃতীয় মেয়াদে ঢাকা ও ত্রিপুরার আগরতলার মধ্যে সরাসরি বাস সার্ভিস চালু হয় এবং ঢাকা কোলকাতার মধ্যে সরাসরি ট্রেন চলাচলের বিষয়টিও চূড়ান্ত করা হয়। তাছাড়া এসময়ে যমুনা সেতুর উপর দিয়ে দেশের পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। এ সময়ে নির্মিত কিছু উল্লেখযোগ্য সেতুর মধ্যে ছিল: ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে শিকারপুর ও দ্বারিকা সেতু, পদ্মা নদীর উপর ফকির লালন শাহ (পাকশী) সেতু, খুলনা-মংলা মহাসড়কে রূপসা নদীর উপর খান জাহান আলী সেতু, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে আড়িয়াল খাঁ নদীর উপর হাজী শরীয়তউল্লাহ সেতু, হেমায়েতপুর-সিঙ্গাইর সড়কে ধলেশ্বরী সেতু, মধুমতি নদীর উপর মোল্লারহাট সেতু, ঢাকার বাবুবাজারে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু, কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারি সড়কের উপর ধরলা সেতু, ডাকাতিয়া নদীর উপর চাঁদপুর সেতু এবং কুশিয়ারা নদীর উপর ফেঞ্চুগঞ্জ সেতু। কুয়েত সরকারের আর্থিক সহায়তায় খালেদা সরকার আরেকটি যে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করেছিলেন তা ছিল চট্টগ্রামের তৃতীয় কর্ণফুলী বা শাহ আমানত সেতু।
খালেদা জিয়ার সরকার জাতীয় সংসদে আইন পাশের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর পরিবর্তে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করে। তবে তাঁর মেয়াদকালে কমিশনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা কখনোই বিতর্কের উর্ধ্বে ছিল না। নিষ্ক্রিয়তার কারণে কমিশনকে প্রায়শই সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। তাঁর সরকারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল ২০০৫ সালে সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা। তবে তাঁর আমলে আমলাতন্ত্রের উচ্চ পর্যায়ে পদোন্নতি বারংবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গেরও প্রচুর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল।
খালেদা জিয়ার তৃতীয় মেয়াদে বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩টি অঙ্গ-প্রতিষ্ঠানের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল: জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ, শান্তি-নির্মাণ কমিশন ও জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ। তাছাড়া এসময়ে বাংলাদেশকে আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য করা হয়। ২০০৫ সালে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের পর তিনি এই সংস্থার চেয়ারপার্সন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সর্বোচ্চ সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করে বিশ্বব্যাপী শান্তি-উদ্যোগেও বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর লড়াইয়ে বাংলাদেশ তখন সর্বাত্মক সমর্থন প্রদান করে। একই সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর সাথেও পারস্পরিক কল্যাণকর সম্পর্ক দৃঢ়তর করার প্রয়াস চালায়। অতীতের মতো এই সরকারও জোটনিরপেক্ষ ও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির ভিত্তিতে একটি উদার ও গণতান্ত্রিক মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়।