জিয়া লাইব্রেরি ডেস্ক : মহান স্বাধীনতার ঘোষক এবং স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতে শোকে মুহ্যমান ছিল গোটা জাতি। তাঁর কফিনের পাশে অবস্থান নিয়েছিল গোটা বাংলাদেশ। ঢাকার সুপ্রশস্ত মানিক মিয়া এভিনিউতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। রাজধানী ঢাকার সব পথই সেদিন মিশে গিয়েছিল এক মোহনায়। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় শহীদ জিয়ার মরদেহ আনার পর তার জানাজায় লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। সবার চোখে ছিল কান্না আর হৃদয়ে শোকানুভূতি। বিপথগামী সেনাসদস্যরা ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোররাতে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করার পর তাঁর মরদেহ সকাল সাড়ে ১০টায় চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৭ মাইল দূরে রাঙ্গুনিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পাশে পাহাড়ের ঢালুতে কবর দেয়। হত্যাকারীরা ওই কবরে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আরও রাখে ওই ঘটনায় নিহত কর্নেল আহসান ও ক্যাপ্টেন হাফিজের লাশ। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ রাখা হয় ওই দুজন সেনা অফিসারে মাঝে।
১ জুন বেলা ১১টায় জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ তোলা হয়। ওইদিন বিকাল পৌনে ৪টায় বিমান বাহিনীর একটি বিমানে চট্টগ্রাম থেকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ ঢাকায় আনা হয়। এ সময় এক বেদনাঘন শোকার্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয় শহরজুড়ে। বিমানবন্দর থেকে জিয়াউর রহমানের কফিনটি একটি সামরিক যানে সেনানিবাসের প্রেসিডেন্ট ভবনে আনা হয়। সেনানিবাসের ১ নং গেট থেকে প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত রাস্তার দু্ই পাশে বিমান বাহিনীর সদস্যরা শ্রদ্ধাবনতভাবে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখান। আর গেটের বাইরে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। কফিনটি প্রেসিডেন্ট ভবনে আনার পর এখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। বেগম খালেদা জিয়া, তাঁদের দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান, আত্মীয়-পরিজন এবং অপেক্ষমাণ লোকজন সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিকাল ৫টায় শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কফিন সংসদ ভবনে নেওয়া হলে সেখানেও তাঁর মৃতদেহ একনজর দেখার জন্য শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জনসাধারণের দেখার সুবিধার জন্য এদিন (১ জুন) রাতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়। ফলে রাত ৯টা পর্যন্ত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ দেখার জন্য পুরনো জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে সমবেত হয় হাজার হাজার মানুষ। মানুষের ঢলে এয়ারপোর্ট রোড, ফার্মগেট, মহাখালী রেলগেট, বাংলামোটর এলাকা পর্যন্ত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এসব এলাকা ও আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রাতে মহিলা, গৃহিণী এমনকি শিশুরা পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের লাশ একনজর দেখার জন্য ভিড় জমায়।
পর দিন ২ জুন সকাল ১১টা পর্যন্ত কফিনটি তেজগাঁও সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে রাখা হলে একই অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেখানে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অগণিত মানুষ শহীদ জিয়াকে শেষবারের মতো একনজর দেখেন। এদিন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়। এসব খবর ওই সময়ের দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দৈনিক আজাদসহ বিভিন্ন পত্রিকা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। একই সঙ্গে পত্রিকাগুলো স্বাধীনতা সংগ্রামে জিয়াউর রহমানের অসামান্য অবদান, একটি নৈরাজ্যকর অবস্থা থেকে রাষ্ট্রের স্থিতিশীল অবস্থা ফিরিয়ে আনা, একদলীয় বাকশালের পরিবর্তে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে জিয়াউর রহমানের সাফল্য ইত্যাদি উল্লেখ করে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
২ জুন দৈনিক আজাদ ‘একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ’ শিরোনামের খবর ৮ কলামজুড়ে প্রকাশ করে। আর দৈনিক ইত্তেফাক এদিন ‘ঢাকায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃতদেহ : অগণিত মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলি’ এবং ‘রাঙ্গুনিয়া পাহাড়ের পাদদেশে জিয়ার লাশ চাপা দেওয়া হয়’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। এর পরদিন অর্থাত্ ৩ জুন দৈনিক আজাদ প্রধান খবর হিসেবে—‘এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ
মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান
পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ দাফন’- শিরোনামে ৮ কলামে প্রকাশ করে। এর পরদিন ৪ জুন বৃহস্পতিবার দৈনিক আজাদ ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ইন্তেকালে জাতীয় সংসদে সর্বসম্মত শোক প্রস্তাব গৃহীত : বিশ্ব এক বিপ্লবী সমাজ সংস্কারক হারাইল’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে ৮ কলামে প্রকাশ করে। আর এদিন দৈনিক ইত্তেফাক ‘সংসদে শোক প্রস্তাব গৃহীত : জিয়া ছিলেন গণতন্ত্রের বিশিষ্ট সাধক জাতীয়তাবাদী চিন্তার অগ্রনায়ক’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে প্রকাশ করে।
এসব প্রতিবেদনে বলা হয়—আধুনিক বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ স্থপতি মরহুম প্রেসিডেন্ট একজন নিঃস্বার্থ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত সত্, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, ধর্মপ্রাণ, সদালাপী ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিজের পরিবারের কথা চিন্তা না করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। অনুরূপ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় বিরল। দৈনিক ইত্তেফাক এবং আজাদে প্রকাশিত কয়েকটি রিপোর্ট তুলে ধরা হলো—
একটি কফিনের পাশে বাংলাদেশ
স্টাফ রিপোর্টার : চট্টগ্রামে বিপথগামী কতিপয় সেনার হাতে গত শুক্রবার দিবাগত রাতে নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ গতকাল ঢাকা আনয়নের পর এক বর্ণনাতীত মর্মান্তিক শোকাবহ দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। রাষ্ট্রপতি জিয়ার লাশ ঢাকা পৌঁছেছে—এখবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নামিয়া পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলামোটর, আসাদগেট এবং মহাখালী রেলগেটের দিক হইতে জনতার স্রোত সংসদ ভবনের দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। ক্রমে জনতার শ্রোতের মুখে ফার্ম গেট হইতে মহাখালী গেট পর্যন্ত সড়কে যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হইয়া যায়। জনতার ঢেউ ছুটিয়া চলিয়াছে একদিকে। মনে হইয়াছে রাজধানী তথা সারা বাংলাদেশের মানুষ জড়ো হইয়াছে একটি কফিনের পাশে। রাষ্ট্রপতি জিয়া ঢাকা প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন। তবে তিনি তার জনতার উদ্দেশে হাত উঁচাইয়া তাহাদের প্রতিউত্তর দেন নাই। লাখো জনতার উত্তাল সমুদ্রে দেহরক্ষীদের চোখ এড়াইয়া অকস্মাত্ গাড়ি থামাইয়া স্বীয় গমন পথে অপেক্ষমাণ খাটিয়া খাওয়া সাধারণ মানুষগুলোর সহিত হাত মিলান নাই। অথবা এই কথাও বলেন নাই আপনারা কেমন আছেন।
তিনি আসিয়াছেন। কিন্তু চির নীরব। চিরনিদ্রায় শায়িত। কফিনের অভ্যন্তরে। কফিন জাতীয় পতাকা এবং পুষ্পে পুষ্পে আচ্ছাদিত।…
গতকাল বিকাল ৫টা হইতে লাশ জাতীয় সংসদ ভবনে রাখা হইয়াছে। আজ সকাল ১১টা পর্যন্ত কফিন সংসদ ভবনে রাখা হইবে। ( দৈনিক আজাদ : ৩ জুন মঙ্গলবার ১৯৮১)
ঢাকায় প্রেসিডেন্ট জিয়ার মরদেহ : অগণিত মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলি
(ইত্তেফাক রিপোর্ট) : এক বেদনাঘন শোকার্ত পরিবেশে গতকাল (সোমবার) চট্টগ্রাম হইতে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মরদেহ ঢাকায় আনয়ন হয়। নিহত প্রেসিডেন্টকে একনজর দেখার জন্য সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে মানুষের ঢল নামে।
গতকাল (সোমবার) অপরাহপ্ত পৌনে ৪টায় চট্টগ্রাম হইতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মরদেহের কফিন লইয়া বিমান বাহিনীর একটি বিমান কড়া নিরাপত্তা প্রহরায় তেজগাঁও বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করিয়ে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ, তিন বাহিনীর প্রধানগণ ও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কফিনটি শ্রদ্ধাসহকারে গ্রহণ করেন। বিমান হইতে কফিনটি বিমান বাহিনীর সদস্যগণ একটি খোলা সামরিক যানে উঠাইয়া নেন এবং কফিনটি পুষ্পস্তবকে সজ্জিত করা হয়। কফিনের সহিত বিমানে বিএনপির সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মহিবুল হাসান, উপমন্ত্রী মিসেস কামরুন্নাহার জাফর এবং প্রাক্তন মন্ত্রী ডক্টর মিসেস আমিনা রহমান আগমন করেন। অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে শোকে মুহ্যমান দেখা যাইতেছিল।
প্রেসিডেন্টের কফিনটি লইয়া সামরিক যানটি সেনানিবাসের প্রেসিডেন্ট ভবনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করিলে বিমান বাহিনীর সদস্যগণ ‘গার্ড অব অনার’ প্রদর্শন করেন। সেনানিবাসের ১নং গেট হইতে প্রেসিডেন্ট ভবন পর্যন্ত রাস্তার দু্ই পার্শ্বে বিমান বাহিনীর সদস্যগণ শ্রদ্ধাবনতভাবে দাঁড়াইয়া থাকিয়া সম্মান দেখান। এই সময় ১নং গেটের বাহিরে হাজার হাজার মানুষ প্রতীক্ষাকুলভাবে দাঁড়াইয়াছিলেন।
কফিনটি প্রেসিডেন্ট ভবনে লইয়া যাওয়ার পর সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। বেগম জিয়াউর রহমান, তাঁহাদের দুই পুত্র, আত্মীয়-পরিজন এবং অপেক্ষমাণ লোকজন সকলেই কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়েন।
সংসদ ভবনে : জনসাধারণের দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লাশের কফিনটি গতকাল অপরাহেপ্ত সাড়ে ৫টায় সংসদ ভবনের সম্মুখে লইয়া আসা হয়। সেখানে প্রথমে সংসদ সদস্যরা শোকাহত চিত্তে কফিনের সম্মুখে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। রাষ্ট্রপতির মরদেহ আনার খবর রাজধানীতে ছড়াইয়া পড়িলে একঘণ্টা সময়ের মধ্যে এয়ারপোর্ট রোডে অগণিত লোক রাস্তায় নামিয়া আসেন। পুলিশ শোকাহত লোকজনকে সারিবদ্ধ করিবার চেষ্টা করে। বাংলামোটর হইতে তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দর পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ হইয়া যায়। আগামীকাল বেলা ১১টা পর্যন্ত কফিনটি সংসদ প্রাঙ্গণে রাখা হইবে। জনসাধারণের দেখার সুবিধার্থে গতরাতে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়।
সংবাদ সংস্থার খবরে বলা হয়, রাত ৯টা পর্যন্ত নিহত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের লাশ দেখার জন্য জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে প্রচণ্ড ভিড় পরিলক্ষিত হয়। কফিন রাখা জায়গার দিকে মানুষের লাইন এয়ারপোর্ট রোডের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আগাইতেছিল। একদিকে ফার্মগেট এবং অন্যদিকে মহাখালী রেলগেট পর্যন্ত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এসব ও আশপাশের এলাকায় মানুষের ভিড় অঘোষিত মিছিলের মতো পরিলক্ষিত হয়।
রাত পর্যন্ত মহিলা, গৃহিণী এমনকি শিশুদের পর্যন্ত ভিড় করিতে দেখা যায়। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দীন হোসেন, আওয়ামী লীগের (মিজান) মিজানুর রহমান চৌধুরী, মুসলিম লীগের খান এ সবুর, জাসদের মেজর (অব.) এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, একতা পার্টির সৈয়দ আলতাফ হোসেন, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের সিদ্দিকুর রহমান, ওয়ার্কার্স পার্টির নাসিম আলী গতকাল সন্ধ্যায় সংসদ ভবনের সম্মুখে শায়িত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কফিনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। (দৈনিক ইত্তেফাক : ২ জুন মঙ্গলবার ১৯৮১)
সংসদে শোক প্রস্তাব গৃহীত : জিয়া ছিলেন গণতন্ত্রের বিশিষ্ট সাধক জাতীয়তাবাদী চিন্তার অগ্রনায়ক
(ইত্তেফাক রিপোর্ট) গতকাল বুধবার জাতীয় সংসদে ভাবগম্ভীর পরিবেশে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করিয়া সর্বসম্মতভাবে একটি শোক প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, জাতীয়তাবাদী চিন্তার অগ্রনায়ক ও গণতন্ত্রের বিশিষ্ট সাধক বলিয়া অভিহিত করা হয়।
প্রস্তাবে মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি ও সমবেদনা জ্ঞাপন করা হয়। শোক প্রস্তাবের পর মরহুমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করিয়া দাঁড়াইয়া দুই মিনিট নীরবতা পালন এবং মোনাজাতের মাধ্যমে তাহার রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়। স্পিকার মীর্জা গোলাম হাফিজ শোক প্রস্তাব পাঠ করেন। প্রস্তাবে বলা হয়, ‘প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অকাল মৃত্যুতে বাংলাদেশ তথা বিশ্ব একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, জাতীয়তাবাদী চিন্তার অগ্রনায়ক, গণতন্ত্রের বিশিষ্ট সাধক, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবক্তা এবং মুসলিম ও তৃতীয় বিশ্বের একজন বিশিষ্ট নেতা ও বিপ্লবী সমাজ সংস্কারককে হারাইয়াছে। প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়, প্রেসিডেন্ট জিয়া অসাধারণ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব এবং বাংলাদেশের অন্যতম সুসন্তান ছিলেন। আধুনিক বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ স্থপতি মরহুম প্রেসিডেন্ট একজন নিঃস্বার্থ দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত সত্, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী, ধর্মপ্রাণ, সদালাপী ছিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি নিজের পরিবারের কথা চিন্তা না করিয়া দেশ ও জনগণের কল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। অনুরূপ আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত দুনিয়ায় বিরল।
প্রস্তাবে আরও উল্লেখ করা হয় যে, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতাকে সুসংহত এবং দৃঢ় করার জন্য ১৯৭৯ সালে সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে সামরিক বাহিনীর লোক হইয়াও সামরিক বাহিনীর নিকট হইতে জনগণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। গণতন্ত্রের প্রতি তাহার গভীর আস্থা ছিল এবং ‘জনগণই ক্ষমতার উত্স’ ইহা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করিতেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্রে জাতিকে সুগঠিত করেন। দেশের দুর্বল অর্থনীতিকে সুদৃঢ় করার চেষ্টা করেন। দেশে আত্মনির্ভরশীল স্বাধীন অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। সাধারণ মানুষের জীবন মান উন্নয়নে ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালাইয়া যান। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আনেন। দেশের ৭০ হাজার গ্রামকে স্বনির্ভর করিয়া গড়িয়া তোলার লক্ষ্যে দেশের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত গ্রামে-গঞ্জে হাট-বাজারে ছুটিয়া বেড়াইয়াছেন। বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত করেন। বিশ্ব মুসলিমদের মধ্যে এক নিবিড় যোগসূত্র স্থাপন করিতে সক্ষম হন। তৃতীয় বিশ্বের মানুষের মধ্যে সংহতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আত্মীয়তার বন্ধনের উদ্দেশ্যে অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালান। তাহার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে এবং বিভিন্ন দেশ সফর করেন। ১৯৮০ সনের ২৬ আগস্ট জাতিসংঘের বিশেষ অধিবেশনে মূল্যবান ও বিশেষ তাত্পর্যপূণ ভাষণ দেন। ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে মক্কা শরিফে অনুষ্ঠিত তৃতীয় ইসলামী সম্মেলনে যোগ দেন এবং ইসলামী সম্মেলনের ৩ সদস্যের ‘আল কুদস’ কমিটির সদস্য হন। ইরাক-ইরান যুদ্ধাবসানে ৯ সদস্যের শান্তি মিশনে শীর্ষস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। তাঁহারই প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আসন লাভ করিতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী, গণতন্ত্রের সাধক, অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক মরহুম জিয়াউর রহমান দেশের ৯ কোটি মানুষের অন্তরে বিশিষ্ট আসন লাভ করিয়া আছেন। তাহার মহান নেতৃত্ব, আত্মপ্রত্যয়ের অনুপ্রেরণা, স্বনির্ভরতার সঠিক পথ প্রদর্শন, দেশ পুনর্গঠনের আহ্বান এবং স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রাম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। (দৈনিক ইত্তেফাক : ৪ জুন, ১৯৮১)
রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর দৈনিক আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ যথাক্রমে ‘জাতি আজ শোকার্ত’, ‘শোকাহত জাতির প্রত্যাশা’ এবং ‘আমরা গভীর মর্মাহত’ শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। এসব সম্পাদকীয় অংশবিশেষ নিম্নরূপ:
জাতি আজ শোকার্ত
আজ আমরা অত্যন্ত বেদনাবিধুর চিত্তে সমগ্র দেশবাসীর সহিত একান্ত হইয়া শোক প্রকাশ করিতেছি। যে নিষ্ঠুরভাবে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জীবনাবসান হইয়াছে তাহার নিন্দা করার ভাষা আমাদের জানা নাই। এই মর্মান্তিক এবং হৃদয়বিদারক ঘটনায় আজ সারা দেশ শোকে মুহ্যমান। গত শনিবার প্রত্যুষে চট্টগ্রামে যে নির্মম হত্যালীলা সাধিত হইয়াছে তাহা সারাদেশের মানুষকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করিয়া তুলিয়াছে। …
তিনিই ছিলেন দেশে জনসাধারণ কর্তৃক প্রত্যক্ষভোটে নির্বাচিত প্রথম প্রেসিডেন্ট। একটি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েমের উদ্দেশ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। সমালোচকদের বক্রদৃষ্টি উপেক্ষা করিয়া তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এই ক্ষেত্রে অগ্রসর হইয়াছিলেন। একজন সৈনিক প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি নিজেকে চিহ্নিত না করিয়া জনগণের প্রতিনিধি হিসাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। দেশে আজ যে গণতন্ত্রের একটি সুষ্ঠু ও সবল ভিত্তি গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অনলস শ্রম ও নিষ্ঠার ফসল।…
একটি স্থিতিশীল সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকিয়া সকল প্রতিকূল পরিবেশ পরিস্থিতিকে আয়ত্তাধীন রাখিয়া প্রেসিডেন্ট জিয়া যেভাবে সকল সমস্যা মোকাবেলা করিতেছিলেন, তাহাতে সাধারণ মানুষ কখনো নৈরাজ্যমূলক মনোভাব প্রকাশ করেন নাই। দেশের মানুষের মনে আশার ক্ষীণ প্রদীপটুকু তিনি সর্বদাই জ্বালাইয়া রাখিতে পারিয়াছিলেন। এইখানেই তাহার কৃতিত্ব। এই জন্যই তিনি অনাগতকালের ইতিহাসে একজন সফল শাসনকর্তা হিসাবে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবেন।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার এই মৃত্যু জাতি ও দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাহার এই আকস্মিক মৃত্যুতে দেশের প্রতিটি মানুষ আজ শোকার্ত। গণতান্ত্রিক যে আদর্শ ও নীতি প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়া দৃঢ় প্রত্যয় নিয়া অগ্রসর হইয়াছিলেন, সেই গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখিয়া দেশ গড়ার মহান সংগ্রামে আত্মনিয়োগের মাধ্যমেই আমরা তাহার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও মমতা প্রকাশ করিতে পারি। আমরা আশা করি, সেই মহান গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত হইয়া মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়ার আরাদ্ধ কাজকে সমাপ্ত করার গুরুদায়িত্ব আগামী দিনের দেশনেতারা গ্রহণ করিতে দ্বিধা করিবেন না। ( দৈনিক আজাদ : ১জুন ১৯৮১)
আমরা গভীর মর্মাহত
জাতির জীবনে এক ক্রান্তিলগ্নে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছিলেন। স্বীয় আদর্শ ও বিশ্বাস অনুযায়ী দেশের উন্নয়নমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেছিলেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি স্বীয় বিশ্বাস অনুযায়ী দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। দেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক সফর ও জনসাধারণের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ স্থাপন করে তাদের সব ধরনের সমস্যা অনুধাবন ও আশা-আকাঙ্ক্ষার পরিচিত হতে প্রতিনিয়ত তিনি নিজেকে নিযুক্ত রাখতে চেষ্টা করতেন।
একান্ত নিজস্ব পন্থায় রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান আশু করণীয় সমূহ সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন করতে চেয়েছেন এবং তাদের অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য প্রশাসনিক গুরুদায়িত্বভার সত্ত্বেও সকল কাজের সঙ্গে নিজেকে নিযুক্ত রাখতে প্রয়াসী ছিলেন। (দৈনিক সংবাদ : ৩১ মে ১৯৮১)
শোকাহত জাতির প্রত্যাশা
জাতীয় জীবনের এক চরম সঙ্কটলগ্নে পরলোকগত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্র তরণীর হাল ধরেছিলেন। জাতীয় জীবন উন্নত করার জন্য তাঁহার ব্যক্তিগত শ্রম ও প্রচেষ্টা ছিল অপার। ক্ষমতা গ্রহণ করার পরবর্তী পাঁচ বছর অবিরাম অবিশ্রান্তভাবে তিনি শুধু ব্যাপক কর্মযজ্ঞের কথাই বলিয়াছেন। তিনি উপলব্ধি করিয়াছিলেন এই দারিদ্রলাঞ্ছিত জাতির মর্যাদা নিয়া বাঁচিয়া থাকার একমাত্র উপায় হইল কর্মোদ্যোগ। তাই শুধু মুখের কথায় দায়িত্ব শেষ না করিয়া জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য তিনি ছুটিয়া গিয়েছেন মাঠে-ময়দানে, খাল-বিল ও নদীর ধারে। তাহার নিরচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলেই জাতির মধ্যে কর্মপ্রেরণা সৃষ্টি হইয়াছিল। ( দৈনিক ইত্তেফাক : ৩ জুন ১৯৮১)